ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

আশুগঞ্জের শুটকি যাচ্ছে বিদেশেও

ইসহাক সুমন, আশুগঞ্জ প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩৭, ডিসেম্বর ৪, ২০১১
আশুগঞ্জের শুটকি যাচ্ছে বিদেশেও

আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া): দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর গ্রামের মেঘনা ও তিতাস নদীর মিঠা পানির চ্যাপাসহ বিভিন্ন মাছের শুটকি।

বছরের আশ্বিন থেকে বৈশাখ এই আট মাস শুটকি উৎপাদনের মৌসুম।

তাই এ গ্রামের শুটকি ব্যবসায়ীরা প্রায় দুই শতধিক মাচার (ডাঙ্গি) ওপর মাছ শুকিয়ে এখন শুটকি তৈরি করছে। প্রথমে শুধু চ্যাপা শুটকি তৈরি হলেও এখন প্রায় ১৬ প্রজাতির মাছের শুটকি উৎপাদিত হচ্ছে লালপুরের এসব মাচায়। আর এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ।

লালপুরের শুটকি সম্পর্কিত কিছু তথ্য
ব্রাহ্মণাবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, নাছিরনগর ও কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিটামইন, তাড়াইল হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন নদী-নালা, বিল, পুকুর, ডোবা ও খালে উৎপাদিত মাছ সংগ্রহ করে মাচায় শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে শুটকি তৈরি হয়।

শুটকি তৈরির প্রক্রিয়া
প্রথমে নারী শ্রমিকরা মাছ কেটে নদীতে ময়লা পরিষ্কার করেন। এরপর এসব কাটা মাছ রোদে শুকানোর জন্য মাচায় রাখা হয়। প্রায় ৪/৫ দিন রোদে শুকানোর পর প্রক্রিয়াজাত করে শুটকি তৈরি করা হয়।
 
নানান শুটকি
কেচকি, আলুনি, পুঁটি, ভেদি, গজার, গইন্না, বোয়াল, টেংরা, চাপিলা, চিকরা, স্টারবাইম, চাঁন্দা, বেটা গুলাইয়া, বাইল্লা, কাইখ্যা ও লংবাইম এই ১৬ প্রজাতির মাছের শুটকি করা হয়। এর মধ্যে দেশে-বিদেশে পুঁটি ও ভেদি মাছ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি চ্যাপা শুটকির চাহিদাই বেশি। স্থানীয় ভাষায় চ্যাপা শুটকি বলা হলেও অনেকে একে শীদল শুটকিও বলে।

চ্যাপা (শীদল) শুটকি প্রক্রিয়াকরণ
বিভিন্ন এলাকা থেকে আহরিত পুঁটি ও ভেদি মাছ মাচার (ডাঙ্গি) উপর ২/৩ দিন শুকানোর পর মাছের তেলে ভিজিয়ে মটকায় (মাটির কলসি) রাখা হয়। পরে পলিথিন দিয়ে মটকার মুখ ভালোভাবে বেঁধে ছায়া ঘেরা আর্দ্র স্থানে রাখা হয়।

দরদাম
প্রতি কেজি পুঁটি শুটকি ১৮০ টাকা, চাঁন্দা ১১০, টেংরা ১৭০, গজার ৩০০, গইন্না ৩০০, চাপিলা ১৫০, কাইখ্যা ২১০, চিকরা বাইম ১৬০, বোয়াল ২৫০ ও বজুরী ১২০ টাকায় পাইকারী দরে বিক্রি করছেন উৎপাদনকারীরা। আর প্রতি কেজি চ্যাপা শুটকি ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।  

মাছের ভুড়ি থেকে তেল
মাছের নাড়ী-ভুড়ি চুলায় জ্বাল দিয়ে মাছের তেল তৈরি করা হয়। এ তেল সাধারণত চ্যাপা শুটকি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর প্রতি কেজি তেল ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

পাঁচ শতাধিক নারীর কর্মসংস্থান
লালপুর গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধীক নারী শ্রমিক শুটকির জন্য মাছ কাটা এবং ধোয়ার কাজ করেন। বিনিময়ে প্রতিদিন মজুরি পান ৪০ থেকে ৫০ টাকা।

নারী শ্রমিক রত্না দাস বলেন, ‘সারাদিন কাজ করে মাত্র ৪০/৫০ টাকা মজুরিতে আমাদের সংসার চলে না। ’

শুটকি ব্যবসায়ীদের কথা
শুটকি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সুহাস দাস, অবিনাশ দাস, মনহোন দাস, সত্য দাস, নির্মল দাস, পরিমল দাস, সুভাষ দাস, দুলাল দাস বাংলানিউজকে জানান, শুটকির ব্যবসা করে অনেক আয় হলেও পুঁজির অভাবে অনেকে ব্যবসা করতে পারছেন না। আর বিভিন্ন এনজিও এবং দাদন ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কিস্তির টাকা শোধ করে ব্যবসা চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে অনেককে। এছাড়া সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে অনেকে সর্বহারাও হয়েছেন।

তারা আরও বলেন, ‘সরকার যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ব্যাংক থেকে শুটকি উৎপাদনের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে তাহলে আমরা এ পেশায় টিকে থাকতে পারব। আর শুটকি উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করতে পারব। ’
 
শুটকি সরবরাহ ও রফতানি
লালপুরে বছরে প্রায় এক লাখ মণ শুটকি তৈরি হয়। এসব শুটকি ঢাকা, চট্রগ্রামসহ সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। তবে গত পাঁচ বছর ধরে রফতানিকারকরা ভারত, ইংল্যান্ড, ইতালি, সৌদি আরব, দুবাইসহ বেশ কয়েকটি দেশে এখন লালপুরের চ্যাপা ও অন্যান্য শুটকি রফতানি করছে। শুটকি বিক্রি করে বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা আয় হয় বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

একটু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ব্যবসায়ীরা শুটকি রফতানি করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।