ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ওহ হো, ডিসেম্বর তো এসে গেছে! বসেন...

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:১৪, ডিসেম্বর ১১, ২০১১
ওহ হো, ডিসেম্বর তো এসে গেছে! বসেন...

মানিকগঞ্জ: ‘বিজয়ের মাস ছাড়া বছরের বাকি ১১টি মাসের প্রতিটি মুহূর্ত কেমন করে কাটে, কেমন থাকি, কী খেয়ে বেঁচে আছি, সংসারই বা চলছে কীভাবে কেউ কোনো খবর রাখে না। বিজয়ের মাস এলেই আমার কথা মনে পড়ে।

দল বেঁধে আসেন নেতা, আমলা, সাংবাদিক। কত মানুষের ভীড় জমে আমার উঠানে। বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত দুই সহযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান ও ইব্রাহীম পরপারে গিয়ে যন্ত্রণার হাত থেকে বেঁচে গেছে, এবার হয়তো আমার পালা। ’

অভিমানী কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বীরপ্রতীক আতাহার আলী খান (৬৭)। অসীম সাহসী এই যোদ্ধা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার অজপাড়া গাঁ বড়াইভিকড়ার পৈত্রিক ভিটেমাটি কামড়ে পড়ে আছেন। বার্ধক্য আর অসুস্থতা ক্রমশ গ্রাস করছে তাকে। তবুও কথা বলেন বীরের মতো স্পষ্ট জবানে।
 
বেতিলা মিতরা ইউনিয়নের বেশ কিছু কাঁচা-পাকা রাস্তা, নদী, খাল পেরিয়ে যাওয়ার পর দেখা মেলে বীরপ্রতীক আতাহার আলী খানের বসত ভিটার। চারিদিকে দারিদ্র্যের দগদগে ছাপ স্পষ্ট, চোখেও পরে সরাসরি। উঠানে মাদুর বিছিয়ে শীতের সকালের রোদে বসে ছিলেন মানিকগঞ্জেরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরপ্রতীক আতাহার আলী।

সাংবাদিক পরিচয়ে কথা শুরু করতেই তার শ্যামল মুখে লুকিয়ে থাকা বিষন্ন ছায়াটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবুও সহজাত বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেনো এসেছেন বাবা?’ তারপর নিজ থেকেই বললেন, ‘ওহ হো, ডিসেম্বর তো এসে গেছে, বসেন। কিছু মনে করবেন না। কেবল বিজয়ের মাস এলেই সবার কাছে আমার কদর বাড়ে তো- তাই অমন করে বলছিলাম। দুঃখটা কী জানেন?’ উত্তরগুলো যেন তার জানা, তাই নিজ থেকেই বলতে থাকেন, ‘বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সে খবর বছরের ১১টি মাস কেউ রাখে না। কেমন থাকি, কী খেয়ে বেঁচে আছি, সংসারই বা চলছে কীভাবে কেউ কোনও খবর রাখে না। ’

এরপর স্বগতোক্তির মত বলতে থাকেন, ‘তিন বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হবার পর থেকেই শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। একটার পর একটা  শারীরিক সমস্যা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আর্থিক সচ্ছলতা কাকে বলে জানি না। একমাত্র ছেলের সামান্য আয়-রোজগারে সংসার চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুষ্ঠানেও গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত দাওয়াত পাই না। যদিও পাই, তাও হয়তো দাওয়াতপত্র দিয়ে যায় অফিসের পিয়ন, অথবা কর্মকর্তাদের বাড়ির কাজের মানুষ। কোনও কোনও দাওয়াতপত্র হাতে আসে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবার পর। বছর দুয়েক আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকায় যে মিলন মেলা করেছিলেন; তার দাওয়াতপত্রটিও আমার হাতে পৌঁছেনি। মানিকগঞ্জ শহরে দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বেশ ক’টি মার্কেট হয়েছে। কিন্তু বহু দেন দরবার করেও একটি দোকানের বরাদ্দ আমার নামে জোটেনি। অথচ অনেক অমুক্তিযোদ্ধা সেসব মার্কেটে দোকান পেয়েছে। ’

একাত্তরের এই বীর সেনানী ক্ষোভ চেপে বাংলানিউজকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়েছে কিন্তু সম্মানি ভাতা খেতাব যাঁরা পাননি তাদেরও দুই হাজার টাকা আবার আমাদের মত বীরপ্রতীকদেরও ওই দুই হাজারই। এই ভাতা বীরপ্রতীক খেতাবের মর্যাদার প্রয়োজনে অন্তত এক টাকা হলেও বাড়ানো হোক। ’

মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞেস করতেই যেন হঠাৎই তারুণ্য ফিরে পেলেন আতাহার আলী। বললেন, ‘১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাস। বাড়ি থেকে বাবার সঙ্গে রাগ করে চট্টগ্রামে চাচার বাড়ি চলে গেলাম। স্কুল জীবনে ভালো ক্রীড়াবিদ ছিলাম। সে সূত্রে চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে ইপিআর (বর্তমানের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এ চাকরি পেলাম। প্রশিক্ষণ শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাটগ্রামে পোস্টিং হল। আট বছর পর, ১৯৭১ সালে এলো মুক্তিযুদ্ধ। ঝাঁপিয়ে পড়লাম যুদ্ধে। ভুরুঙ্গামারী কলেজে পাকিস্থানী হানাদারদের একটি ক্যাম্পে হামলা করে সব তছনছ করে দিয়েছিলাম। আমাদের ঝটিকা হামলায় ২০ জনের মত পাকি নিহত হয়েছিল। এ ক্যাম্প থেকে পাকিসেনাদের বেশ কিছু অস্ত্রও আমাদের হস্তগত হয়। এরপর রায়গঞ্জে পাকিদের হেড কোয়ার্টারে আক্রমণ চালাই। এ আক্রমণে বীর বিক্রমে লড়াই করে লে. সামাদসহ আমাদের ১২ থেকে ১৩ জন যোদ্ধা শহীদ হন। ’

তিনি বলে চলেন, ‘আমরা বাধ্য হয়ে পিছু হটে আসি। তবে এ ঘটনার প্রতিশোধ নেবার জন্য আমরা পাগল হয়ে পড়েছিলাম। সেদিন ছিল ১৪ই ডিসেম্বর। এবার আর ব্যর্থ হইনি। আমাদের মরণপণ হামলায় রায়গঞ্জ হেড কোযার্টারে অবস্থানরত ১শ’রও বেশি পাকি সৈন্যকে আমরা খতম করি। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ প্রায় ৯মাস বৃহত্তর রংপুর, লালমনিরহাট, রায়গঞ্জ, জয়মনিরহাট ভুরুঙ্গামারীসহ বিভিন্ন যুদ্ধে সামনের কাতারে থেকেই অনেক যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। ’

এ পর্যায়ে গৌরবে জ্বলজ্বল করতে থাকা চেহারায় আতাহার আরী বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হবার পর আমার স্বীকৃতি মিলেছিল। পেয়েছিলাম মর্যাদাপূর্ণ বীরপ্রতিক খেতাব। একজন সৈনিকের জন্য এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!’

তবে যুদ্ধশেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ফের চাকরিতে যোগ দিলেও পূর্ণ মেয়াদে চাকরি করবার ভাগ্য বীরপ্রতীক আতাহার আলীর হয়নি।

আতাহার আলী বলেন, ‘১৯৮৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভালুকাপাড়ায় অবস্থিত আমাদের ক্যাম্পে তৎকালীন শান্তিবাহীনি আক্রমণ চালালে আমাদের ৩ সৈনিক শহীদ হন। হামলা ঠেকানোর ব্যর্থতার অভিযোগে ১০ বিডিআর সদস্যের সঙ্গে আমাকেও বরখাস্ত করা হয়। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ থাকার পরও আমার চাকরি চলে গেল। মন্ত্রণালয়ে ঘুড়ে ঘুড়ে অনেক আকুতি জানিয়েও চাকরিটা আর ফিরে পাইনি। এরপর থেকে বহুদিন অর্ধহারে অনাহারে কাটাতে হয়েছে পরিবার নিয়ে। ওই কষ্ট ভুলে মনে করেছিলাম চাকরি গেছে তো কি হয়েছে! আমি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা! এই সম্মান নিয়েই হয়তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবো। কিন্তু রাজনীতি করি না বলে অথবা বিত্ত-বৈভব নেই বলে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সে সম্মানটাও কেউ আগের মত দেয় না। এটুকু যে দেয় তাও যেন করুণা করেই দেয়। এমন করুণার সম্মানকে আমি ঘৃণা করি!’

মুক্তিযুদ্ধের সাহসী এই যোদ্ধা যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন তাঁর দুচোখ গড়িয়ে টপটপ ঝরে পড়ছিল আবেগের বিন্দু।                                                                                         

এলাকার সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এবং দাবি, এই বীরপ্রতীককে যেন তার সম্মানে বাঁচোনোর চিন্তায় আর আহাজারি করতে না হয়। জীবন সাহাহ্নে এসে যেন অভাব অনটনের ক্রুরতা সহ্য করতে না হয়। তাদের আরও দাবি, এলাকার গর্ব, দেশের গর্ব আতাহার আলী খান বীরপ্রতীকের নামে গ্রামের পাশের ধলেশ্বরী নদীর ওপর একটি পাকা সেতু যেন করা হয়।                                                                 

বাংলাদেশ সময়: ২২০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।