স্বাধীনতা আর আমি বয়েসে দু’জন প্রায় সমান। আমাদের জন্মের ব্যবধান মাত্র এক মাসের।
তারা জানেন, সন্তান পেটে নিয়ে পাকি সেনা ও বাঙালি রাজাকারদের ভয়ে কী করে প্রতিটি মুহূর্ত পার করতে হয়েছে, কী রকম অসহায় লাগে দিনের পর দিন নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে বনে-বাদাড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে লুকিয়ে থাকতে, কী দুঃসহ যন্ত্রনা হয় মা-বাবার সামনে তার আদরের নিস্পাপ শিশু সন্তানকে হত্যা করলে, সম্ভ্রম হানি করলে, ধরে নিয়ে গুম করে ফেললে। আমি তো তখন কেবলি শিশু, আমি তাই এসবের কিছুই জানি না। আমার মতো হাজারো মানুষ যাদের জন্ম স্বাধীনতার সময় অথবা পরে অথবা তখন অবুঝ, তারাও এসবের কিছুই জানেন না!
আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা ইতিহাস জানতে শুরু করেছি। ভাষাদিবস, স্বাধীনতাদিবস, কালরাত্রি এবং বিজয়দিবস সম্পর্কে জেনেছি অথবা আমাকে জানানো হয়েছে। কে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, কে প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, কে কে রশি ধরেছিলেন, কে পতাকার বাঁশ দিয়েছিলেন এসব নিয়ে রীতিমত আরেকটি যুদ্ধ সংগঠিত হবার যোগাড়! স্বার্থপরতার চরম পরিচয় দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে তাদের নেতাই যে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই মিথ্যেকে সত্যে পরিণত করার আন্দোলনে উন্মাদ হয়েছে। বারবার ভুল ইতিহাস তুলে ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। অথচ স্বাধীনতার কয়েক যুগ পার হলেও স্বাধীনতার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন, পরিবার হারিয়ে, সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্বের মতো জীবন কাটিয়েছেন, তাদের খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
পত্রিকায় খবর ছাপে- ‘মুক্তিযোদ্ধা ওমুক এখন পথে পথে ভিক্ষে করছেন’। তা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ (সবাই না) সাধারণ মানুষ আফসোস করেছেন। অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মর্মর্স্পশী স্মৃতি মনে করে নিভৃতে চোখ মুছেছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করেছেন- এমন স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম?
স্বাধীনতার জন্য যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, প্রতিদানের পরিবর্তে তাদের ওপর তারা প্রতিশোধ নিয়েছেন নানাভাবে। স্বাধীনতার পর প্রতিদান হিসেবে প্রথমেই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তারপর হত্যাকারীদের আশ্রয়, পূনর্বাসন এবং ইনডেমনিটি বিল পাশ করে এই নৃশংস হত্যাকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের গাড়িতে আমাদের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একের পর এক রাজাকাররা ধনী থেকে আরো ধনাঢ্য হয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমাগত দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম!
উপরের উদাহরণগুলোকে একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, জাতি হিসেবে এমন অকৃতজ্ঞ ও এমন নিমক হারামীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই।
আমরা কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম? পাকিস্তানের মত বন্দুকের জোরে মেজর থেকে জেনারেল তক সরকারের চাকররা ক্ষমতায় বসে বারবার আমাদের নিতম্বে লাথি কষবেন! স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও রাষ্ট্রের কাছে ভিখিরির মত অনুনয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে হবে! বিজয়দিবসে সারা দেশে লাখ লাখ টাকা খরচ করে অনুষ্ঠান করা হবে অথচ অসহায়, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের টাকাও হবে না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার সনটিও বলতে পারেন না, যাদরে রিক্সায় চড়ার মুরোদ হবার কথা না- এমন নামধারী যেনতেন ছাত্রনেতাদেরও আজকাল পাজেরো গাড়ি হবে। কিন্তু, মুক্তিযোদ্ধার শিক্ষিত সন্তানদের একটি বাইসাইকেল কেনারও সামর্থ্য হবে না।
চরম অপমানের ব্যাপার হল, আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রেই প্রাপ্য সম্মানটুকুও জানানো হয় না তাদের!
কিন্তু কেন? কী তাদের অপরাধ? জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা? এখন তো স্বাধীনতার পক্ষে যারা রয়েছেন রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের হাতেই। তাহলে এতগুলো বছর পরেও কেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারগুলো ভালো থাকবে না, সম্মান জানানো হবে না? কত কত ফালতু কাজে টাকা খরচ হচ্ছে? অথচ তাদের বেলায় টাকা নেই। কেন? তারা তাদের রাইফেলগুলো জমা দিয়ে দিয়েছেন বলে? কব্জির জোড় কমে গেছে বলে?
স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে আমি রাজনীতিবিদ এবং যেসব মুক্তিযোদ্ধা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন, তাদের কাছে এ প্রশ্নটি করতে চাই।
চল্লিশতম বিজয়ের উৎসব গত হয়েছে, আজ (১৭ ডিসেম্বর) থেকে হয়তো আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের কেউ খুব একটা স্মরণও করবেন না। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের ৪ দশক পূর্তিতে শ্রদ্ধেয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম! আশা করি অন্যরাও এর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদেরকে অন্তত সারা বছর জুড়ে প্রাপ্য সম্মানটুকু জানাবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০২ ঘণ্টা, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১১