ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

এখনো বিজয়ের স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ

মাহবুব আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৪৭, ডিসেম্বর ২৭, ২০১১
এখনো বিজয়ের স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ

আবারও বাংলার বুকে বিজয়ের বার্তা নিয়ে আসছে ১৬ ডিসেম্বর! বাঙ্গালি জাতি পালন করতে যাচ্ছে তাদের ৪০ তম বিজয় উৎসব।

এমনই বিষেশ মুহূর্তে বাংলানিউজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন মুক্তিযোদ্ধা মো: ফরিদ উদ্দিন ।

পেশায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের ল্যাবরেটরি সহকারী। গ্রামের বাড়ী কুমিল্লার মেঘনা (পূর্বে হোমনা) উপজেলার ২ নম্বর রাধা নগর ইউনিয়নের রতনপুর। ৭ ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনি ২য়। কৈশোরেই তাঁর  মাকে হারান।

তাঁর বাবা মোজাফফর আলী মেম্বার ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আর্দশে অনুপ্রাণিত এক নির্ভীক সৈনিক। ছেলেকেও তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শেই অনুপ্রাণিত করেন।

১৯৭১ সালে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর হায়দারের অধীনে এবং মেজর গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে  তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

যুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চে  বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণে বাবার সঙ্গে আমিও রেসকোর্সে ছিলাম। সঙ্গে আমার এলাকার আরো ৫/৬ জন ছিল। ভাষণ শুনেই আমার মধ্যে যোদ্ধা-যোদ্ধা মনোভাব জেগে উঠলো।

এরপর ২৬শে মার্চ দেশব্যাপী যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে আমার মনোভাবকে বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম। বাবাও আমাকে সমর্থন জানালেন।

বাবা আমার ৩জন সঙ্গীসহ রাতের অন্ধকারে ভারতের আসাম রাজ্যের বখননগর ইযুথ ক্যাম্পে নিয়ে যান। ফেরার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুশিক্ত নয়নে বললেন, ‘বাবা দেশের স্বাধীনতার জন্যে তোমাকে কোরবান করে দিলাম। যদি বেঁচে থাকো তবে স্বাধীন বাংলাতেই আবার দেখা হবে। ’ তিনি আর কোন কথা বলতে পারেননি ।

এদিকে এই ক্যাম্পে কোন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় এখানে অবস্থানরত বাঙ্গালীদের গ্রপে ভাগ করে আসামের বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হয়। আমাকে পাঠানো হয়েছিল এ রাজ্যের ওমতি নগরে । এরপর সেখান থেকে ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরে কুমিল্লার হোমনা ও দাউদকান্দির বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করি।

যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে জানা যায়, দেশে যখন চারিদিকে বিজয়ের সাজ সাজ রব। তখনও তিনি এ এলাকাকে (হোমনা-দাউদকান্দি) হানাদার মুক্ত করতে যুদ্ধ লিপ্ত । সেদিন ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী ঢাকায় যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করলেও মেঘনা তীরবর্তী হোমনায় আক্রমণরত পাঞ্জাবী সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসর্মপণ করে নি।

পরদিন ১৭ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর কিছু সৈনিককে হটালেও ১৮ ডিসেম্বর ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। তিন দিক দিয়ে পাক সৈন্যদের ঘিরে ফেললেও ওরা পিছু হটছিল না। ট্রেইনার ইব্রাহিমের পরিচালনায় তাদের গ্রুপটা এত বেশি অগ্রসর হয়েছিল যে যুদ্ধের এক পর্যায়ে সহযোদ্ধা ও তাঁর চাচাত ভাই আ. রহিম, ট্রেইনার ইব্রাহিম, আবু মিয়াসহ আরো ৫/৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়। তখন তাদের দিকে বৃষ্টির মত গুলি আসছিল। এ সময় তাঁর চাচাত ভাই পা ধরে টেনে পাঞ্জাবীদের তৈরি করা বাঙ্কারে তাকে ফেলে দিলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান বলে জানান। পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে অত মুক্তিযোদ্ধারা আহতদের মইয়ে করে অনেক কষ্টে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপরই এলাকা শত্রুমুক্ত হয় বলে শোনা যায়।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খুব গৌরববোধ হয় উল্লেখ করে তিনি বাংলানিউজকে বলেন,‘আমার কাছে সবকিছুর উর্দ্ধে ছিলো দেশাত্ববোধ। তাই দেশ ও দেশের স্বাধীনতার জন্যে নিজ হাতে অস্ত্র ধরেছি , মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে মুক্তি দিয়েছি কোটি মানুষকে। এ কথাগুলো মনে হলে আজও এ বয়সেও আবার নতুন করে অশুভ শক্তির বিরোদ্ধে যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা পাই।  

ফরিদ মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র প্রকৃত স্বাধীনতার ব্যাপারে বলতে গিয়ে বলেন, ‘একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি ঠিকই কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা আজও পাইনি। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন হলে ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং বঞ্চনামুক্ত একটি দেশ পাব। কিন্তু চলার পথে যখন দেখি আর্বজনার স্তুপ থেকে মানুষ খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছে, বস্তিতে মানবেতর জীবন-যাপন করছে অসংখ্য নর-নারী তখন যেন স্বাধীনতার স্বপ্ন ডুকরে কেঁদে মরে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি তো নয়ই এমনকি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও অর্জিত হয়নি। এজন্যই কি দেশ স্বাধীন করেছিলাম !

আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সমাজ ব্যবস্থার নিম্ন স্তর পর্যন্ত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ব্যপক প্রভাব ও সক্রিয় উপস্থিতি। এ অবস্থায় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করি।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ বলেন, ‘রাজাকার আলবদরদের বিচার যদি ১৬ ডিসেম্বরের আগে হয় তাহলে আমরা আরেকটি বিজয় দেখতে পারবো। আর এ বিজয়টি দেখতেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ’

সবশেষে তরুন প্রজন্ম সম্পর্কে তার বক্তব্য, তারা যেন এত কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে কোন অপশক্তির হাতে তুলে না দেয়। পারস্পারিক সহযোগিতা, সোর্হাদ্য ও সম্প্রতির বন্ধন অটুট রেখে সোনার বাংলাকে সমৃদ্ধশালী করতে এবং অগ্রগতির শীর্ষে পৌছে দেওয়ার জন্যও তিনি তরুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।