ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সালতামামি

আনন্দ বেদনার দ্বৈরথে বিদায় ২০১১!

আসাদুল হক খোকন, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:২৬, ডিসেম্বর ২৭, ২০১১
আনন্দ বেদনার দ্বৈরথে বিদায় ২০১১!

আর মাত্র ক’দিন বাকি। ঝরা পালকের মতো আমাদের জীবন থেকে ঝরে পড়বে আরও একটি বছর।

এক মুহূর্তেই বদলে যাবে ৩৬৫ দিনের ছকে বাঁধা নানা পরিকল্পনা, আশা-নিরাশা, পাওয়া-না পাওয়া আর ঘটনা-দুর্ঘটনার বছর ২০১১ এর পুরনো ক্যালেন্ডার।

তার স্থান দখল করবে ২০১২ এর নতুন পঞ্জিকা!

কিন্তু পুরনো ক্যালেন্ডার সরিয়ে ফেললেও সরানো যায় না পুরনো বছরের ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি। আমাদের প্রিয়জন, শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় আমাদের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেওয়াদের মধ্যে অনেককে ২০১১ সালে হারিয়েছি, তেমনি অনেকেই নানা অর্জন, ত্যাগ ও ভালোবাসায় জায়গাও করে নিয়েছেন হৃদয়ের কন্দরে। এসব নিয়ে বছর শেষের আগেই দেনা-পাওনার মতো আমরা হিসেব করতে থাকি স্মৃতির মণিকোঠায় জমে থাকা- সালতামামি- ২০১১।

সে বিচারে নানা বৈচিত্রময় ঘটনা-দুর্ঘটনা, সুখ-দুঃখ, আলোচনা-সমালোচনায় ঠাসা ২০১১ কে একবাক্যে ঘটনাবহুল বলা যায়। তবে জাতি হিসেবে বিস্মৃতিপরায়ণ বলে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভুলে যাই। আবার কখনো বা তুচ্ছ ঘটনাকেও ভাবি মহামূল্যবান। তবে জটিল গুরুগম্ভীর সে তর্কে না গিয়ে ২০১১ এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস: ইতিবাচক

maternityবছরের শুরুতেই শেখ হাসিনা সরকার মায়েদের বাড়তি সুবিধা বিবেচনা করে ৪ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিকে বাড়িয়ে ৬ মাস করেছেন। এতে নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পেয়েছেন বলে মনে করেছেন অনেকেই। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অন্যেরাও। এবং সম্ভবত এই একটি বিষয়ে কোনও নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন। অথবা গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টির প্রতি তাদের দৃষ্টিই পড়েনি!

বছরজুড়ে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নানা কর্মসূচি দিলেও গড়পরতায় এর সবই পালিত হয়েছে খুবই ঢিলেঢালাভাবে। অন্যদিকে কোনো কোনো কর্মসূচিতে সরকারি বাধা বা প্রতিরোধও খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি অনেকেই। তবে বছর শেষে বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশকে ঘিরে পুলিশি বাধা এবং অন্যদিকে গাড়িতে আগুন দিয়ে নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারা ২০১১ কে কলঙ্কিত করেছে।

ডালমে কুচ কালা হ্যায়!

জনবহুল দেশ হিসেবে পরিচিত দেশের মোট জনসংখ্যার হিসেব জানতে এ বছর পরিচালিত হয়েছে আদমশুমারি ২০১১। প্রাপ্ত হিসেব অনুযায়ী দেশের বর্তমান মোট জনসংখ্যা ১৪,২৩,১৯,০০০জন , পুরুষ ৭,১২,৫৫,০০০ জন এবং ৭,১০,৬৪,০০০ জন মহিলা বলে জানানো হয়। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতে দেশের জনসংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। সরকার পরিচালিত অতীতের আদমশুমারি নিয়েও তাদের মতামত অভিন্ন পরিলক্ষিত হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের মনোভাব হচ্ছে ‘ডালমে কুচ কালা হ্যায়’!

বিশ্বকাপে স্বাগতিক টাইগারদের ‘মার্জার রূপ’

world২০১১ সনের উল্যেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে আর একটি হলো- বিশ্বকাপ ক্রিকেট। কয়েকটি দেশের পৃথক ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত এ খেলায় স্বাগতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পারফর্মেন্স ছিল খুবই বাজে। কাগুজে বাঘদের মার্জারবৎ পারফর্মেন্সে চরম হতাশ দেশের অগুনতি ক্রিকেট ভক্ত খেলা দেখাই প্রায় ছেড়ে দেন! এনিয়ে এখানে বিস্তারিত চর্চা তাদের পুরনো ক্ষতে নুনের ছিটার মতই মনে হতে পারে, তাই এ নিয়ে আর কথা না বাড়ানো সমীচীন মনে হচ্ছে।

 

আলোচিত আরও সব ঘটনা

doelবিরোধী দলের নিরুত্তাপ হরতাল পালন, র্যাব-লিমনের ঘটনা, মীরসরাই ট্রাজেডি, রূপগঞ্জে জমি নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশ ও সেনা সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের সাউথ সাউথ পুরস্কার লাভ, সুন্দলপুরে দেশের ২৪তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, নতুন ৫ জাতীয় অধ্যাপক নিয়োগ, দেশের প্রথম ল্যাপটপ দোয়েল উৎপাদন শুরু, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর, মালদ্বীপে বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপন,  জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ঢাকা সফর, আড়িয়াল বিলে বিমান বন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ ও পরে সরকারের সেই অবস্থান থেকে সরে আসা, যুক্তরাজ্যের নিউজার্সি সিনেট কর্তৃক খালেদা জিয়াকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভীর বাজিমাত, সারাদেশে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প, বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলের ওয়ানডে স্ট্যাটাস লাভ এবং উপমহাদেশ ভাগের ৬৪ বছর পর দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া প্রভৃতি ছিল ২০১১ সালের উল্যেখযোগ্য ঘটনাগুলোর অন্যতম।

নারায়ণগঞ্জে আইভীর বাজীমাৎ

ivyতবে অবশ্যই সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য ঘটনা ছাপিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরশন নির্বাচন যেভাবে পুরো জাতিকে আলোড়িত করেছে তা এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে থাকবে। এ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে ডা. সেলিনা আইভী শুধু নবগঠিত এ পৌরসভার প্রথম মেয়রই নির্বাচিত হননি, তিনি দেশের প্রথম নারী মেয়রও নির্বাচিত হন।

টিপাইমুখ নিয়ে সরগরম সব দল

tipaimukhশুরু থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত মাঝে মাঝেই টিপাইমুখ ইস্যু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় সরগরম থেকেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। বিরোধী দল ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে কিছু সরকার বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করার চেষ্টা করলেও তা ছিল প্রত্যাশার তুলনায় ‍তা ছিল দায়সারা।

অন্যদিকে সরকারের মুখপাত্রসহ কেউ কেউ টিপাইমুখ পরিদর্শনেও গিয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে। অর্থাৎ, বলা যায় টিপাইমুখ বন্ধ করতে গিয়ে নিজেদের মুখ বন্ধ করে ফিরে আসেন তারা!

লিমন-সাভার-কাদের-মিলন: র‌্যাব-পুলিশের কৃতিত্বে কলংক তিলক

savarবছরজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ এবং র‌্যাব আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। ছিনতাইকারী, মাদক ব্যবসায়ী, অপহরণকারী, ধর্ষক, খুনীসহ বিভিন্ন অপরাধী আটক ও তাদের আইনের বিচারের মুখে সোপর্দ করে র‌্যাব সুনাম অর্জন করলেও লিমনের ঘটনায় তাদের সে সুনাম অনেকখানিই ক্ষুন্ন হয়েছে।

অন্যদিকে শবেবরাতের রাতে সাভারে ৬ ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার সময় হত্যাকারীদের সহায়তা দান করার ঘটনা পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা বিশেষ করে ছাত্রদের ডাকাত সাজানোর চেষ্টা ছিল এর মধ্যে অন্যতম। ডাকাত সন্দেহে নিহত ৬ জনকে পরবর্তীতে আদালত ছাত্র বলে রায় দিলে পুলিশের ভূমিকা ফাঁস হয়ে যায়।
একইভাবে আবদুল কাদের নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকেও ছিনতাইকারী বলে পুলিশ আটক করে। পরে তার পায়ে চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তার নামে মিথ্যা মামলাও করে পুলিশ।

কোম্পানীগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে গণিটুনিতে শামছুদ্দীন মিলন(১৬) নামে এক নিরপরাধ কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনা মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। মামলার আরজিতে বাদী চর ফকিরা গ্রামের প্রবাসী গিয়াস উদ্দীনের স্ত্রী কোহিনূর বেগম উল্লেখ করনে, গত ২৭ জুলাই সকালে শামছুদ্দীন মিলন জমি রেজিস্ট্রি করতে বাড়ি থেকে ১৪ হাজার টাকা নিয়ে উপজেলা সদরে যায়। চরকাঁকড়া গ্রামের আকু মাঝি বাড়িতে থাকা খালাতো বোন চুমকির সঙ্গে কথা বলতে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে স্থানীয় স্কুলের পাশের মসজিদ ঘাটে বসে অপক্ষা করছিল মিলন। এসময় স্থানীয় মিজানুর রহমান ওরফে মানিক শামছুদ্দীনের কাছে সেখোনে বসে থাকার কারণ জানতে চান।

একর্পযায়ে সেখানে আসেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরষিদ (ইউপ) সদস্য জামাল উদ্দিন (ছোট জামাল)। একর্পযায়ে তারা পাশের বিদ্যালয় থেকে খালাতো বোন চুমকিকে ডেকে এনে তার পরিচয় সর্ম্পর্কে নিশ্চিতও হন। কিন্তু ইউপি সদস্য জামাল ও মিজানুর মিলনকে মারধর করে সঙ্গে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন এবং আহত অবস্থায় তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। অভিযোগে জানা গেছে, মোবাইল আর টাকা ইউপি সদস্য ও পুলিশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়।

পরে পুলিশ তাকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে আহত করে এবং হাসপাতাল বা থানায় না নিয়ে স্থানীয় বাজারের কাছের তিন রাস্তার মোড়ে ফেলে দিয়ে যায়। এসময় সেখানে উপস্থিত লোকজন ডাকাত সন্দেহে শামছুদ্দীনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নিরপরাধ মিলনের লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করা এ নির্মম ঘটনার দৃশ্য টিভি সংবাদে যারা দেখেছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন, এ ঘটনা দুঃস্বপ্নকেও হার মানায়!  

ঘটনা সম্পর্কে মিলনের চাচা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ওইদিন মিলন মোবাইল ফোনে তাকে আটকে রাখার কথা আমাদের জানিয়েছে। আমি তার মাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয় লোকজন আমাদের জানায়, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে মিলনকে উত্তেজিত জনতার হাতে সঁপে দয়ে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আবার এসে লাশ নিয়ে যায়। ’ এখানে এই ক্ষুদ্র পরিসরে মিলনের ঘটনাটি সবিস্তার বর্ণনা করা হলো এ আশায়- যেন আগামী বছর বা তার পরের বছরগুলোতেও এমন কোনও ঘটনা আর না ঘটে- যেখানে রক্ষকই নির্দয় ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়!

বিপদে নিরপরাধ মানুষের বন্ধু তথা সাহায্যকারী হওয়ার বদলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী ‍বাহিনীর কিছু নীতিহীন সদস্যের এ ধরনের অমানবিক আচরণ আর অসৎ কারসাজি সমগ্র পুলিশ বা ৠাবের ব্যাপারে জনমনে বিরাজমান ভীতি ও অবিশ্বাস আরও মজবুত করে তোলে।

এ ধরনের বাস্তবতা পুলিশ বিভাগের বা ৠাবের অতীতের অন্য যে কোনও সুনাম নষ্ট করতে যথেষ্ট! একই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা আইন-শৃংখলা বাহিনীতে কর্মরত সৎ-কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিদের জন্য বিব্রতকর আর সাধারণ জনগণের জন্য হতাশা আর আতংকেরও।

খালেদার পুরস্কার প্রাপ্তি

khaledaবছরের মাঝামাঝি সময়ে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ পুরষ্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যের নিউজার্সি যাওয়ার ঘটনা আলোচনায় আসে। গণতন্ত্র, সন্ত্রাস দমন ও নারীর ক্ষমতায়নে তাকে যুক্তরাজ্যের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের সিনেট এ পুরস্কার প্রদান করে। তবে; তার সমালোচকরা মনে করেন- নানা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য শেখ হাসিনা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের বিশেষ পুরস্কার লাভ করলেও এর বিপরীতে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম জিয়া দীর্ঘ্যদিন ক্ষমতায় থাকলেও সেরকম কিছু পাননি। তাই এবার সে ঘাটতি মিটাতে তার ঘনিষ্ঠ মিত্ররা এই পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন!

 

 

বেপরোয়া দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া

অন্যান্য বছরগুলোর মতোই এবারও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েই চলেছে। বিষয়টি নিয়ে সংবাদপত্রসহ বিরোধী দল বেশ কয়েকবার সরকারকে বলার চেষ্টা করেছে। একপর্যায়ে  রমযান উপলক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্যের বাজাদর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তারা তা করেননি। বরং কোনও কোনও পণ্যের দাম পূর্বের তুলনায় বেড়েছে। এমনকি রমযান ও ঈদুল আযহার পূর্বে কোথাও কোথাও স্বল্প সময়ের জন্য বাজার থেকে চিনি হাওয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে!

ফেলানী হত্যা: দেশ-বিদেশে ভারতীয় সমান্তরক্ষী বিএসএফ’র সমালোচনা

felaniবছরের অন্যান্য ঘটনাগুলোর মধ্যে সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে বাংলাদেশি তরুণী ফেলানীর করুন মৃত্যু সমগ্র জাতিকে নাড়া দিয়েছে। জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজ এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়ে তথ্যনির্ভর সংবাদ প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। পরে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বিএসএফ তথা ভারতকে। এর ফলে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় সীমান্তে অহেতুক গুলি করে নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা না করার। কিন্তু বরাবরের মত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি বিএসএফ। বছরের শেষ মাসেও সীমান্তে গুলি করে ৩ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা।

 

 

তারেক-মিশুকের মর্মান্তিক মৃত্যু: আবুল-শাজাহান নির্ঘণ্ট

tarekমর্মান্তিক সড়ক দুঘটনায় প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ ও শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে বাংলাদেশে টিভি সাংবাদিকতায় আধুনিকতার পুরোধা মিশুক মুনীরের মৃত্যু সংস্কৃতি আর মিডিয়া জগৎসহ পুরো জাতিকেই শোকবিহ্বল করে। একই সঙ্গে মিরসরাইয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় অর্ধশত কোমলমতি শিশু-কিশোরের নির্মম মৃত্যু জাতিকে শোকে হতবিহ্বল করে দেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনও একক সড়ক দুর্ঘটনায় এতগুলি মৃত্যু, বিশেষ করে শিশু-কিশোরের মৃত্যুর ঘটনা আর ঘটেনি। এমনকি বিশ্বের অন্য কোনও দেশেও এ ধরনের ঘটনা বিরল। এছাড়া জুলাইয়ের শেষপ্রান্তে বগুড়ার শাহজাহানপুরের নন্দীগ্রামে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে ১৮ জনের মৃত্যুর ঘটনাও শোকাবহ করে তোলে দেশের মানুষকে। এর আগের মাসে ট্রাকের সঙ্গে পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই উপজেলার ৯মাইল এলাকায় নির্বাচনী দায়িত্ব পালনরত পলিশের ৪ সদস্যসহ পিকআপ চালক নিহত হন।      

mishukএসব ঘটনার বিপরীতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ‘আবুল’ এর দায়িত্বহীন মন্তব্য আর নৌমন্ত্রী শাহজাহানের গাড়ি চালকদের জন্য আলগা দরদ আর মায়াকান্না বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত এবং একই সঙ্গে ভাবিত করেছে।

তবে বছরের শেষে আবুলকে অন্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেয়া হলেও সাধারণ জনগণ খুশি হতে পারেনি। বছরজুড়ে সমালোচিত মন্ত্রীদের মধ্যে এবার আবুল ও শাহজাহান ছিলেন শীর্ষে! সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানও ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। বিশেষ করে বছরের শেষ প্রান্তে এসে রেলমন্ত্রী হওয়া একই দলের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ফারুক খানকে উদ্দেশ্য করে ‘কম খান’ মন্তব্য বেশ আলোচিত ছিল।

তবে বছরজুড়ে নিজ দল ও সরকারের কৌশলী সমালোচনায় মুখর আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী পরিষদে যুক্ত হওয়ার ঘটনায় সাধারণ্যে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মাঝে সন্তোষ লক্ষ্য করা গেছে।

 

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু

golamদীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ইস্যু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তবে এবার সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এবং এজন্য গঠন করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ দায়ের মামলায় এরই মধ্যে জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীসহ দলটির শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অচিরেই গ্রেপ্তার হতে যাচ্ছেন ৭১ এ বাঙালিনিধন, ধর্ষণসহ নানান যুদ্ধাপরাধে হানাদার পাকিদের সহযোগী জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমও।

একই অপরাধের অবিযোগে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে গ্রেফতারের আগে এবং পরে সাকা চৌধুরীর ভাঁড়সুলভ মন্তব্য বরাবরের মতোই সংবাদ মাধ্যমগুলোর জন্য ছিল বেশ হট আইটেম!

গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সঙ্কটে অসহায় জনগণ

গ্রীষ্মের পুরো সময় ধরে বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। প্রচণ্ড গরম আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং জনজীবন অতীষ্ঠ করে তুলেছিল। সামর্থ্যর্বানরা আইপিএস, জেনারেটর কিনে কষ্ট লাঘবে সচেষ্ট হয়েছেন তবে নিচের সারিতে থাকা মানুষ ছিলেন বরাবরের মত অসহায়। এসময় সুযোগ বুঝে, খারাপ মান ও বেশি দাম নিয়ে দেদারছে বাণিজ্য করেছে কিছু আইপিএস ও জেনারেটর বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান। অনেক গ্রাহক আবার কিনেছেন নবতর প্রযুক্তির সোলার প্যানেল। অপরদিকে, বিদ্যুৎ সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার সূত্রে ওয়াসার পানি সরবরাহে ঘাটতি ছিল এর মধ্যে বাড়তি সমস্যা।

যানজট

বছরজুড়ে রাজধানীতে যানজট লেগেই ছিল এবং আছে। যখন তখন রাস্তা বন্ধ, রিক্সার পথ পরিবর্তন ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রসাশন এসমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলেও মূলত সমস্যা কাটেনি। আর সদ্য প্রাক্তন নগরপিতা খোকার প্রায় বছরজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুড়ি নগরবাসীর যাতায়াত সমস্যাকে আগুনে ঘি ঢালার মতো বাড়িয়ে তুলেছে!েএকই সেঙ্গ সইতে হয়েছে মশার যন্ত্রণাও। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগানের বিপরীতে এসব ছিল বেশ বেমানান।

ভূ-কম্পন আতঙ্ক, শৈত্যপ্রবাহে রেকর্ড মৃত্যু

গত ৬২ বছরের মধ্যে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল এ বছরই। আর বছরের একেবার শেষে শীতের তীব্রতা দেশের উত্তরের জেলাগুলোর জনজীবন প্রায় স্থবির কে এনেছে। চলমান শৈত্য প্রবাহ ও শীতজনিত রোগে দেশের নানাস্থানে প্রায় ৭০ জনের মৃত্যু ঘটে যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সর্বোচ্চ। এসব মিলে ২০১১কে আমাদের দীর্ঘদিন মনে থাকার কথা!

দেশের বাইরের বড় ঘটনা

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এবছর ঘটেছে উল্যেখযোগ্য অনেক কিছু। অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নেভি সিল নামের দুর্ধর্ষ কমান্ডো বাহিনী কর্তৃক বিন লাদেন হত্যা, লিবীয় নেতা কর্নেল গাদ্দাফির মৃত্যু, জাপানের ফুকুশিমায় ভয়াবহ ৮.৮ মাত্রার ভুমিকম্প ও সুনামি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া, সিরিয়ায় সরকার পতনের আন্দোলন, তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের সফল পরিণতিতে মিসরে হোসনি মোবারক যুগের অবসান- আরো কত কী!

এসব সাড়া জাগানো ঘটনার সঙ্গে ২০১১ তে আরও একটি প্রসঙ্গ বিশ্বসংবাদ মাধ্যম তথা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সুনামির মতই- তা হলো ভিন্ন ধারার সংবাদসূত্র উইকিলিক্স। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মার্কিন দূতাবাস এবং গোয়েন্দাদের পাঠানো হাজার হাজার গোপন রিপোর্ট প্রকাশ করে উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ব্রেকিং আর স্কুপ সংবাদপ্রেমী মিডিয়াকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে রূপকথার রাজকুমারে পরিণত হন। উইকিলিক্স ফাঁস করা মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কিত কয়েক হাজার গোপন তথ্যও প্রকাশ পায়। এ ঘটনা সামাল দিতে ওবামা প্রশাসনকে কঠিন বেগ পেতে হয়েছে তা অনস্বীকার্য।

অপরদিকে উইকিলিক্স কাণ্ডের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকেও পড়তে হয় মামলা ও কারাবরণের তিক্ত অভিজ্ঞার মুখে। যদিও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বৃটেনে কারাবন্দি হয়েছিলেন ভিন্নধারার একটি মামলায় তবে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিমাত্রই বুঝে নিয়েছেন যে এর সঙ্গে মার্কিন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার ঘটনাই সম্পর্কযুক্ত। শেষ পর্যন্ত মামলা মুক্ত হয়ে বন্দিদশা থেকে অ্যসাঞ্জ মুক্ত হন। অ্যাসাঞ্জের বন্দি থাকাকালে দুনিয়াজুড়ে তার সমর্থনে মানুষের ব্যাপক শুভাসীষ আর কর্মকাণ্ডও এক ইতিহাসই বটে। এসময় তাকে নোবেল দেওয়ার দাবিও উঠেছিল।

বছরের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত মনু্ষ্যবিহীন অত্যাধুনিক স্টিল্থ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান ড্রোন ইরানের মাটিতে নামিয়ে আনার ঘটনা ইরান-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েনে নয়া মাত্রা যোগ করে। একইসঙ্গে ‘রূপকথা’র ড্রোন বিমান নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি নিজেদের করায়ত্ব করার ইরানি দাবিও বিশ্বজুড়ে সমরবিদদের নতুন ভাবনার খোরাক এনে দেয়।

তাদের কথা মনে পড়বে খুব!

abdur২০১১ তে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয় পপসম্রাট মুক্তিযোদ্ধা আযম খান, বিএনপি মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত গজল শিল্পী জগজিৎ সিং, মানুষ মানুষের জন্য খ্যাত অসমী গায়ক ভূপেন হাজারিকা, অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এবং ২০১১ এর শেষ প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাককে।

২০১১ জুড়ে ছোটখাটো নানান অর্জনের সুখভোগের পাশাপাশি হারানোর বেদনাটা এবার বোধহয় বেশিই ছিল। বলা যায় ওইসব হারানোর দুঃখের পাশাপাশি জায়গা করে নেবে নানা অর্জনের সুখও। আগামী বছর ২০১২তেও আমরা সেইসব গুণী আর প্রিয়জনদের স্মরণ করবো বেদনায়, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়!

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।