চট্টগ্রাম: চারদিকে ছায়াঢাকা পাখিডাকা সুনশান নীরবতা। যেদিকে চোখ যায় পটে আঁকা ছবির মতো সাজানো গোছানো।
কোথাও হিজল-জারুল-চম্পা, কোথাও সোনালী ফুলের গাছ উঁকি মারছে। মাঝে সারি সারি কবর। আবার সারি সারি বাহারি ফুলের মেলা। ফুটে আছে লাল, সাদা আর হলুদ লেনটানা, কেরিঅপসিস, রঙ্গন।
ফুলে ফুলে টইটম্বুর গাছগুলো শোভা বাড়াচ্ছে। সৃষ্টি করছে নৈসর্গিক পরিবেশ। যেখানে সকাল, দুপুর আর বিকেলে আলোছায়ার খেলায় ঘন ঘন রুপ পাল্টে যায়।
প্রজাপতি উড়ছে পাখনা মেলে। তরুণ-তরুণীরা জুটি বেঁধে হাতে হাত রেখে ঘুরছে। চোখে বিস্ময়, হৃদয়ে ময়ূরের পেখম খোলা আনন্দ। প্রকৃতি আর মানুষের অপার সৌন্দর্যের হাতছানি।
চোখ জুড়ানো এমন সৌন্দর্যের দেখা পাবেন পাহাড়-সাগর আর অরণ্যঘেরা চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রিতে। এখানে ঢুকতে কোনও টিকিট কাটার ঝক্কি নেই। বিনামূল্যেই উপভোগ করবেন অনাবিল আনন্দ, মন ভরে যাবে শুদ্ধতার পরশে। তবে আপনাকে যেতে হবে সকাল ৮টা থেকে ১২টা বা বেলা ২টা থেকে ৫টার মধ্যে।
নগরীর প্রাণকেন্দ্রে জিইসি, প্রবর্তক, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চারুকলা ইনস্টিটিউটের কাছেই ওয়ার সিমেট্রির অবস্থান। ঠিকানা: ১৯ বাদশা মিঞা চৌধুরী সড়ক।
পাহাড়ের কোলঘেঁষে কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি কমিশনের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি। যেখানে আছে ৭৫১টি সমাধি।
ওয়ার সিমেট্রি এলাকায় ঢুকতেই চোখে পড়বে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের সৌজন্যে একটি ফলক। সেখানে আছে চারটি নির্দেশিকাÑ
গেট বন্ধ থাকা অবস্থায় খোলার জন্য দয়া করে অনুরোধ করবেন না। এখানে সমাহিত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং নীরবতা পালন করার জন্য দর্শনার্থীদের প্রতি অনুরোধ রইল। দয়া করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। সিমেট্রি এলাকায় বসা নিষেধ, দয়া করে দেখে চলে যাবেন।
আপনার চোখে পড়বে কর্মীরা কেউ মেশিন দিয়ে সবুজ ঘাস কাটছেন। কেউ পাতা কুড়িয়ে নিচ্ছেন আবার কেউ চারাগাছে পানি দিচ্ছেন। সযতে যে যার কাজে নিমগ্ন।
প্রধান ফটক পেরিয়ে একটু এগোলেই চট্টগ্রাম স্মৃতিপীঠ, গির্জা আকৃতির ছোট্ট স্থাপনা। হাতের ডানপাশে রাখা আছে কাচের ঘেরার মধ্যে সুদৃশ্য বিশাল মেমোরিয়াল রেজিস্ট্রার। লেখা আছেÑ
১৯৩৯-১৯৪৫Ñ যে ৬৫০০ নাবিক ও বাণিজ্য জাহাজের লস্কর দেশমাতৃকার সেবায় মৃত্যুবরণ করিয়াছে সমুদ্রের অতল তল ভিন্ন যাহাদের আর কোনও সমাধি নাই এই পুস্তকে তাহাদের নাম রহিল।
রেজিস্ট্রারের হাতে লেখা গোটগোট অক্ষর। নামের বানানও সেকেলে। পদবিও অনুরূপ।
শিরোনাম লেখা আছে মার্চ্যান্ট নেভি। এর নিচে আছে দোমালা গ্লাসগো।
নামগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাকÑচিন মিঞা, গুলাম হুসেন, গোমেস এ, ইরাদ মিঞা, জোবাদ আলি, কালা মিঞা, লুতফ আলী, মনমথ মণ্ডল প্রমুখ।
পদবিও কেমন যেন অপরিচিতÑজেনারেল সার্ভ্যান্ট, ব্যেকারস মেট, কুক্, অয়েল ম্যান, ট্রিমার, উইচম্যান, টোপাস, চিফ কুক, ব্যকার, সীম্যান, বুচারস মেট, ল্যাম্পম্যান ইত্যাদি।
কবরস্থানের ঠিক মাঝখানে শ্বেতশুভ্র ক্রুশ মাথা উঁচু করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বপাশে ছিমছাম প্রার্থনাঘর। যেখানে দেশি-বিদেশি খ্রিষ্টান নর-নারীরা এলে শ্রদ্ধাভরে প্রার্থনা করেন। সেখানে লেখা আছে ইংরেজি ও বাংলায় ওয়ার সিমেট্রির পরিচিতি ও মানচিত্র।
পরিচিতিতে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাকÑ
চট্টগ্রাম রণ সমাধি ক্ষেত্র। চট্টগ্রাম স্মৃতিপীঠ। গভীর জলের পোতাশ্রয় চট্টগ্রাম ছিল একাধারে আরাকান সামরিক তৎপরতার একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটি এবং একটি উল্লেখযোগ্য হাসপাতাল কেন্দ্র।
মূলত: হাসপাতালের মৃতদের জন্য সৃষ্টি হলেও অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ক্ষেত্র থেকে শবদেহ গ্রহণের উদ্দেশ্যে সমাধিভূমিটি সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এখানে ৭৫১টি সমাধিতে রয়েছেন ১৪ নাবিক, ৫৪৩ সৈনিক, ১৯৪ বৈমানিক। সমাধিস্থলে যুদ্ধকালীন সমাধি ছাড়া আরও ৪টি সমাধি কবর রয়েছে।
বিভিন্ন দেশের সমাধির একটি পরিসংখ্যানও আছে সেখানে। যাতে বলা হয়েছে- যুক্তরাজ্য ৩৭৮, কানাডা ২৫, অস্ট্রেলিয়া ৯, নিউজিল্যান্ড ২, অবিভক্ত ভারত (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) ২১৪, পূর্ব আফ্রিকা ১১, পশ্চিম আফ্রিকা ৯০, বার্মা ২, নেদারল্যান্ডস ১ ও জাপানের ১৯ জন।
ছায়া সুনিবিড় ওয়ার সিমেট্রি দেখতে এসেছিলেন হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা মোসাম্মৎ উম্মে তাইজিন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামে দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। আবার অনেক কিছুই আধুনিকায়নের নামে প্রবেশের টিকিট সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সে ক্ষেত্রে ওয়ার সিমেট্রি একদিকে ঐতিহাসিক স্থান।
অন্যদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য মন ভালো করে দেয়। বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। মজার ব্যাপার হলো এখানে ঢুকতে কোনও ধরনের টিকিট কাটতে হয় না।
ওয়ার সিমেট্রি রক্ষণাবেক্ষণের মূল দায়িত্ব পালন করেন ব্যবস্থাপক আবু সাইয়িদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখানে দেশি পর্যটক ছাড়াও বিদেশিরা আসেন। এখানে সমাহিত লন্ডনের এক ভদ্রলোকের কন্যা এসেছিলেন। খুব কান্নাকাটি করেছিলেন।
এ ধরনের ওয়ার সিমেট্রি দেশে আর কোথাও আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের কাছে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি আছে।
ওয়ার সিমেট্রির পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি মূলত কবরস্থান হলেও সৌন্দর্যের কারণে নানা বয়সী পর্যটক আসেন। ছবি তোলেন। আনন্দ পান। তবে আমরা ফুল ছিঁড়তে, গাছের ডাল ভাঙতে, বসে গান-বাজনা করতে নিষেধ করি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১২