ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ফার্মেসির দোকানি থেকে স্কয়ার গ্রুপের কর্ণধার

ইসমাইল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৪৬, জানুয়ারি ৫, ২০১২
ফার্মেসির দোকানি থেকে স্কয়ার গ্রুপের কর্ণধার

ঢাকা: বাংলাদেশের ব্যবসা অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা স্যামসন এইচ চৌধুরীর ব্যবসাজীবন শুরু হয়েছিল খুব স্বল্প পরিসরে। স্যামসনের বাবা ছিলেন হাসপাতালের আউটডোর ডিসপেনসারির মেডিক্যাল অফিসার।

সে সূত্রে ওষুধ-পত্রের সঙ্গে জানাশোনা শৈশব থেকেই।

তাই যৌবনে ওষুধশিল্পে মনোনিবেশ এবং ক্রমে এ শিল্পসহ অন্যান্য ব্যবসায়ে মহীরুহ হয়ে ওঠার বীজ তার পিতার পেশাসূত্রেই তার মধ্যে অঙ্কুরিত হয়েছিল বলা যায়।

স্যামসন চৌধুরী প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে নিজ গ্রাম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাবনার আতাইকুলায় ফিরে এসে সামান্য ফার্মেসির দোকোনে শুরু করেন জীবিকার লড়াই। সেটা ১৯৫২ সালের ঘটনা।

এরপর ১৯৫৮ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে উদ্যমী স্বভাবের স্বপ্নবাজ যুবক স্যামসন চৌধুরী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধীরেন দত্তের কাছে গেলেন একটি আবদার নিয়ে। চাইলেন ওষুধ কারখানা স্থাপনের লাইসেন্স এবং পেয়েও গেলেন।

এরপর ছেলেবেলার চার বন্ধু প্রত্যেকে ২০ হাজার টাকা করে দিয়ে গড়লেন মোট ৮০ হাজার টাকার ফান্ড। সেই পুঁজিতে পাবনায় ওষুধ কারখানা স্থাপন করলেন চার বন্ধু। নাম স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস।

চারজন অংশীদারের সমান মালিকানায় শুরু হয় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের কর্মযজ্ঞ। স্কয়ারের নামকরণ প্রসঙ্গে স্যামসন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এটি চার বন্ধুর প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া আমাদের চার হাত সমান। এর লোগোও তাই বর্গাকৃতির। ’

ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির লোকজনের কাছে স্যমাসন এইচ চৌধুরী এক আইকন। ছোট্ট ওষুধ কারখানা স্কয়ারকে তিনি এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেখানে স্কয়ার পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানির তালিকায়ও শীর্ষে উঠে এসেছে।

১৯৫৮ সালের সেই ছোট উদ্যোগ বর্তমানে বিশাল গ্রুপে পরিণত। ২৭ হাজার কর্মীর এই বিশাল পরিবারের বার্ষিক আয় ৩০ কোটি ডলার।

‘স্কয়ার’ শুধু ওষুধেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। টেক্সটাইল, টয়লেট্রিজ, কনজ্যুমার প্রডাক্টস, স্বাস্থ্যসেবা, মিডিয়া, এমনকি বাড়ির রান্নাঘরেও সগৌরব উপস্থিতি স্কয়ারের। মিডিয়ায় উপস্থিতি মাছরাঙা টিভির মাধ্যমে।

ব্যবসা মানেই মুনাফা- এ ধারণাকে অনেকটাই ভুল প্রমাণ করেছে স্যামসন এইচ চৌধুরীর নেতৃত্বে স্কয়ার গ্রুপ। এ কথার সঙ্গে দ্বিমত তার চরম প্রতিপক্ষও করবেন না।

‘আমার কাছে কোয়ালিটিই সবার আগে। সব পর্যায়েই আমরা কোয়ালিটি নিশ্চিত করি’ বলতেন কোয়ালিটিম্যান স্যামসন চৌধুরী। তার প্রমাণও রেখে গেছেন স্কয়ার ব্রান্ডিংয়ের সব পণ্য আর সেবাতে এই কর্মবীর।

ব্যবসা ও বিপণনে সাফল্যের জন্য কোনও বিশেষ কৌশল প্রসঙ্গে স্যামসন চৌধুরী বলতেন, ‘আমি সব সময় স্বপ্ন দেখেছি বিশ্বের নামিদামি ওষুধ কম্পানির আদলে গড়ে উঠুক স্কয়ার; যেখানে নিয়মিত গবেষণা হবে, উন্নয়ন হবে, কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ থাকবে সব পর্যায়ে। এখানে প্রায় ৮০ ভাগই হোয়াইট-কলার জব। তাঁদের সবাই গুণ-মান বজায় রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট, প্রশিক্ষিত। আমরা একটা পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছি। আমাদের ওষুধের কোয়ালিটি আজ দেশে-বিদেশে স্বীকৃত। ডাক্তাররা অবিচল আস্থার সঙ্গে আমাদের ওষুধ প্রয়োগ করেন। পৃথিবীর ৫০টি দেশে আমাদের ওষুধ যাচ্ছে। ’

ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কম্পানিগুলোর এক ধরনের যথেচ্ছচার দেখা যায়। এ ব্যাপারে স্কয়ার ফার্মার কর্ণধার বলেন, `মানসম্পন্ন ওষুধের দাম নির্ধারণের ব্যাপারে সরকারের কার্যকর নীতিমালা না থাকায় আমাদের অসুবিধা হচ্ছে। মাছের বাজারে তাজা মাছ আর পচা-বাসি মাছের দাম এক হয় না। ওষুধ কেনার সময় সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। `

দেশের গুরুত্ব¡পূর্ণ অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই শিল্পপতি। তিনি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি, মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্টেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস’র (এমআইডিএএস) চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন তিনি।

তিনি ঢাকা ক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান ছিলেন ২০০৪-২০০৭ সাল পর্যন্ত। শাহবাজপুর টি এস্টেট ও মিউচুয়াল স্ট্রাস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।

২০০৯-১০ অর্থ বছরে সেরা করদাতা নির্বাচিত হয়েছেন স্কয়ার গ্রুপের উদ্যোক্তা স্যামসন চৌধুরী। তার সাথে ছিলেন তাঁর তিন ছেলে তপন চৌধুরী, অঞ্জন চৌধুরী ও স্যামুয়েল চৌধুরী।

স্যামসন চৌধুরী ২০০৯-১০ অর্থবছরে ব্যক্তি করদাতা হিসেবে আয়কর দিয়েছেন এক কোটি ৬৩ লাখ ২২ হাজার ১৮১ টাকা। তাঁর ছেলে তপন চৌধুরী আয়কর দিয়েছেন এক কোটি তিন লাখ ৪৩ হাজার ৩৫ টাকা। অঞ্জন চৌধুরী আয়কর দিয়েছেন ৭৭ লাখ ১২ হাজার ৮৩২ টাকা। স্যামুয়েল এস চৌধুরী ৭৬ লাখ ৫৫ হাজার ৬৮৪ টাকা আয়কর দিয়েছেন।

নিজের শখ-আহ্লাদ লালন করতেন স্যামসন চৌধুরী। ছবি তুলতেন অনেক আগ থেকে। ১০-১২টি ক্যামেরা ছিল তার। কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে ছবি তোলার জন্য বের হতেন তিনি। ছবি তুলেছেন ঢাকা শহরের পুরনো ঐতিহ্যের নিদর্শনগুলোর।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।