ঢাকা : দেশি-বিদেশি পাখিদের গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল বাইক্কা বিলে ক্রমেই বাড়ছে পাখির প্রজাতি ও এদের সংখ্যা। বিলের পাখির তালিকায় যুক্ত হওয়া নতুন এসব পাখি শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়-পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে- অত্যন্ত বিরল প্রজাতিরও বটে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল-হাওরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত বাইক্কা বিল।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আবহাওয়া উপযোগিতা, খাদ্যের প্রাপ্যতা এই স্থানটিকে নিরাপদ ও স্বাচ্ছ্যন্দময় হিসেবে ভাবছে পাখিরা। বিশেষ করে, ২০০৩ সালে হাইল হাওরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত বাইক্কা বিলকে স্থায়ী অভয়াশ্রম ঘোষণার পর থেকে এখানে মাছের পরিমাণ বেড়েছে, বেড়েছে অন্যান্য জীববৈচিত্রও।
যার ফলে পাখিদের খাদ্যর কোন ঘাটতি নেই এই বিলে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের গবেষণায় বাইক্কা বিলে বিরল প্রজাতির চার পাখির সংযোজনের তথ্য জানানো হয়েছে। বার্ড ক্লাব অতিথি চার পাখির চমৎকার নতুন নামও দিয়েছে।
এরা হচ্ছে- বড়ঠুঁটি নলফুটকি, যার ইংরেজি নাম Large-billed Reed Warbler. বৈজ্ঞানিক নাম Acrocephalus orinus, উদয়ী নলফুটকি, ইংরেজিতে Oriental Reed Warbler. বৈজ্ঞানিক নাম Acrocephalus orientalis, বৈকাল ঝাড়ফুটকি, ইংরেজি নাম Baikal Bush Warbler, বৈজ্ঞানিক নাম Bradipterus davidi ও সাইক্সের ফুটকি, এর ইংরেজি নাম Sykes’s Warbler, বৈজ্ঞানিক নাম Hippolais rama.
বাইক্কা বিলে ৯৮ প্রজাতির দেশি মাছ ও ১৬০ প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি রয়েছে বলে দাবি করা হলেও এ সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পাখির বিচরণ আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় অধিবাসীরাও।
বাইক্কা বিলের পশ্চিম পাড়ের বাসিন্দা মোঃ আব্দুল হাশেমের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৪০) জানান, ``পাক্কা ১৫ বছর ধরি ইখানো আছি। কয়েক বছর ধরি পাকি (পাখি) বাড়ছে। সকাল বেলা আর সইন্ধার সময় পাকির কেচরম্যাচর বাড়ি (বেড়ে) যায়! কতো মাইনষে ইখানো আয় (আসে) দেখবার লাগি। ``
বাইক্কা বিল তথা হাইল হাওর অঞ্চলে পাখির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে- এটি আমাদের জীববৈচিত্রের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করছে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিধানে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। শুধু তাই নয়- পাখি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে পাখিদের এই বিচরণকে ঘিরে সৃষ্ট পর্যটন-সম্ভাবনা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার জন্যও সহায়ক হতে পারে।
এমন ধারণা বিবেচনায় এনে সরকারি, বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি প্রয়াসে ওই এলাকায় চলছে পাখি চেনানো, সংরক্ষণ ও বংশ বিস্তারে সহযোগিতামূলক মানসিকতা তৈরীর জন্য সচেতনতা এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি ও পাখি বিশেষজ্ঞ ড. ইনাম-আল হক বাংলানিউজকে জানান, বাইক্কা বিলে পাখির প্রাচুর্য দেখতে প্রচুর পর্যটক এখানে আসছেন। পর্যটকদের আগমনের মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদের যাতে একটি আয়ের পথ হয়- সেজন্য আমি ব্যক্তি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
এ প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য স্থানীয় বাসিন্দাদের বিলের পাখিদের সঙ্গে পরিচিত করা, যাতে তারা পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করতে পারে। পাখি আমাদের ও প্রকৃতির সম্পদ। এদের রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। স্থানীয়দের মাঝে এ বোধ জাগ্রত করাও প্রশিক্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য।
ড. হক আরও জানান, আমি ২০ বছর ধরে বাইক্কা বিলে যাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি- এ বিলে পাখিসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র উত্তরোত্তর বাড়ছে। নতুন প্রজাতির প্রজাপতি নতুন যোগ হচ্ছে। এক সময় এদেশে লাখ লাখ বালি হাঁস ছিল। তারা জলাশয়ের তীরে গাছের কুঠরে বাসা বাঁধতো। বাচ্চা ফুটাতো- ধীরে ধীরে এ হাঁস শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
সুখের কথা হচ্ছে- বাইক্কা বিলে আবার বাড়ছে বালিহাঁস। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিলের তীরবর্তীস্থানে কৃত্রিমভাবে তৈরি করে দেওয়া কাঠের বাক্সে বাচ্চা ফুটিয়েছে। এছাড়া বাইক্কা বিলে পরিযায়ী সৈকত পাখিদের রিং পরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বে এ পর্যন্ত ২ কোটি পাখিকে রিং পরানো হয়েছে। আমরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে। বাংলাদেশে মাত্র ৫শ পাখিকে রিং পরানো গেছে। এর মধ্যে বাইক্কা বিলের রয়েছে ৪শ পাখি। এর মাধ্যমে পাখি গবেষকরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবেন। রিং পরানোর বিষয়টি অনেকটা পাখিদের পরিচয়পত্রের কাজ করবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১১