ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ইতিহাস সংরক্ষণে আমাদের উদাসীনতা ও ঢোপকল

শাফিক নেওয়াজ সোহান, নিউজরুম <br>এডিটর ও শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫৯, জানুয়ারি ৫, ২০১২
ইতিহাস সংরক্ষণে আমাদের উদাসীনতা ও ঢোপকল

ঢাকা: ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে বাঙালির উদাসীনতা সর্বজন বিদিত। তা সে প্রাচীন স্থাপত্য হোক, বা পুরাতাত্ত্বিক নির্দশন।



শতবর্ষের অবহেলায় এ জনপদ থেকে মুছে গেছে স্বর্ণালি অনেক ইতিহাসের সাক্ষি। হারিয়ে গেছে পুরাতাত্ত্বিক নির্দশন।

তেমনি একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক রাজশাহীর ‘ঢোপকল’। তবে সংরক্ষণের অভাবে অচিরেই এটিও হয়তো হারিয়ে যাবে।

পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু এই পানিই দূষিত হলে তা হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যুর কারণ।

একবার রাজশাহী শহরের পানীয় জল পানের অযোগ্য হয়ে পড়ে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আমাশয়-কলেরাসহ পানিবাহিত নানা রোগ। দিশেহারা হয়ে পড়েন নগরবাসী।

সময়টা ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি। পানির এ সঙ্কট নিরসনে কলকাতার তত্ত্বাবধানে রাজশাহী শহরজুড়ে স্থাপন করা হয় শতাধিক পানির কল। দেখতে অদ্ভুত এ পানির কলগুলোই পরে ‘ঢোপকল’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

সেই থেকে রাজশাহীবাসীর সঙ্গে দীর্ঘ ৭৫ বছরের সম্পর্ক ঢোপকলগুলোর।

এক একটা ঢোপকল মাটি থেকে সাড়ে ১১ ফুট লম্বা। আর এ গম্বুজাকৃতির কলগুলো তৈরি করতে তৎকালে ব্যবহার করা হয়েছিল সাদা সিমেন্ট (সেই সময় একে বিলেতি মাটি বলা হতো)।

তবে পুরো নকশাটা তৈরি হয়েছিল টিনের শিট দিয়ে। প্রথমে টিনের শিটের একটা বলয় তৈরি করা হতো। এর উপর দেওয়া হতো সাদা সিমেন্টের ঢালাই।

সহজে যাতে না ভাঙে তাই ঢোপকল তৈরিতে তিনদফা সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া হতো। দিনে দিনে কলগুলো সুপেয় পানির আধার হয়ে ওঠে। পরিচর্যা আর পরিসেবায় ক্রমেই রাজশাহীর শহরবাসীর মনে স্থান করে নেয় কলগুলো।

তবে যতোটা সহজ মনে হচ্ছে ততোটা সহজ ছিল না ঢোপকল তৈরির ইতিহাস।

কলকাতা অনুমোদন এবং সহায়তা দিলেও তা ছিল অপ্রতুল। অর্থসঙ্কটের কারণে ঢোপকল প্রকল্প ভেস্তে যেতে বসেছিল।

অনেকের কাছে এ কল বানানোর জন্য অর্থ সহায়তা চাওয়াও হয়েছিল। এর মধ্যে তৎকালীন ধনীদের মধ্যে এগিয়ে আসেন রাজশাহী জেলার পুঠিয়া জমিদার বাড়ির রানী হেমন্তকুমারী।

তিনি 65 হাজার টাকা দান করেন কল স্থাপনে। পুরো প্রকল্পটি শেষ করতে ব্যয় হয়েছিল পৌনে তিন লাখ টাকা।

রানী হেমন্তকুমারীর প্রতি সম্মান জানাতে তাই ঢোপকল প্রকল্পটির নাম রাখা হয়েছিল ‘হেমন্তকুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস। ’

পৌর কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় রাজশাহীর সোনাদিঘি থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হতো এসব ঢোপকলে। নগরবাসী ঢোপকল থেকে সে পানি সংগ্রহ করে তাদের নিত্য প্রয়োজন মেটাতেন।

লোকমুখে শোনা যায়, ঢোপকলের পানি শুধু তৃষ্ণাই মেটাতো না। অনেক ক্ষেত্রে রোগের দাওয়াই হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। এর মধ্য দিয়ে একটা জিনিস পরিস্কার যে, ঢোপকল থেকে একই সঙ্গে স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যেতো।

কিন্তু সেদিনের সেই কষ্টার্জিত ঢোপকল আজ অবহেলিত। শহরের শতাধিক ঢোপকলের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি বর্তমানে সচল আছে। অচল ঢোপকলগুলো দিয়ে পানি বেরুলেও তা আর বিশুদ্ধ নেই।

সিটি করপোরেশনের উদাসীনতা আর অপরিকল্পিত নগরায়নের কাছে হার মেনেছে ঐতিহ্যবাহী ঢোপকলগুলো। কোথাওবা  ঢোপকল ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে বসতভিটা।

ইতিহাস সংরক্ষণে আমাদের উদাসীনতার এটিও এক দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।