ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ভারতে নব্যধনীরা এখন অপহরণকারীদের লক্ষ্য

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:৪৪, জানুয়ারি ৮, ২০১২
ভারতে নব্যধনীরা এখন অপহরণকারীদের লক্ষ্য

নয়াদিল্লি: বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভারত। পয়সাওয়ালা মানুষদের পদভারে ন্যুব্জ এখন মুম্বাই, চেন্নাই আর দিল্লির মতো শহর-নগর।

লাল-নীল আলোয় উজ্জ্বল ঝলমলে এইসব শহরে বিলাসব্যসনের কোনো অভাব নেই।

তবে ভোগবিলাসিতায় কোনো কার্পণ্য না থাকলেও এখানে কিন্তু নাগরিক নিরাপত্তার অভাব রয়েছে ভয়াবহ। আর্থিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এখানে হাত ধরাধরি করে বেড়েছে অপরাধ প্রবণতাও। অপহরণের নগরীতে পরিণত হয়েছে এখন এসব জনপদ। এক জরিপে দেখা গেছে, অপহরণ সন্ত্রাসের দিক দিয়ে ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বিপজ্জনক দেশ। আর অহরহ অপহরণের শিকার যারা হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই ঝলমলে নগরীতে বসবাস করা নব্যধনী।

পুলিশ দাবি করছে,তারা নাটকীয় উদ্ধার অভিযান চালিয়ে এ ধরনের অনেক অপহৃতকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন,এই সংখ্যা খুবই নগণ্য। তাদের বক্তব্য হলো- এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা পুলিশের ওপর নির্ভর করেন না। অপহৃত প্রিয়জনকে ফিরে পেতে তারা লাখ লাখ রুপি মুক্তিপণ দিয়ে দেন গোপনে।

উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি নয়দা অঞ্চলের ব্যবসায়ী কপিল গুপ্তের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি অপহরণের শিকার হলে তার স্ত্রী সোনিয়া একাই পুরো বিষয়টি সামাল দিয়েছেন। অর্থাৎ অপহরণকারীদের সঙ্গে সমঝোতা করে (অর্থের বিনিময়ে) তাকে ছাড়িয়ে আনেন।

এ প্রসঙ্গে সোনিয়া বলেন,ডিএনডি ফ্লাইওভার থেকে আমার স্বামী অপহৃত হয়। পুলিশকে এ ঘটনা জানানোর ২৪ ঘণ্টা পর আমি একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল পাই। মুক্তিপণ হিসেবে ৫ কোটি রুপি দাবি করে অপহরণকারীরা। আমি নিজে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করি। আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে খুব কষ্টে এক কোটি রুপি সংগ্রহ করি।

একজন আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে তাদের কথা মতো নির্দিষ্ট জায়গায় টাকার ব্যাগ রেখে আসার ১৬ ঘণ্টা পর তার স্বামীকে মুক্তি দেয় দুর্বত্তরা।

নব্য ধনীরা অপহরণের লক্ষ্যতে পরিণত হওয়া প্রসঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (সিবিআই) সাবেক পরিচালক জোগেন্দর সিং বলেন,অপহরণকারী তাদের সম্ভাব্য শিকার ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের গতিবিধিই শুধু নজরে রাখে না, তারা খোঁজখবর রাখে শিকার কতোটা ধনী। এই ধরনের অপরাধের পেছনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো রাতারাতি ধনী হওয়া।

এ ধরনের ঘটনার শিকার মুম্বাইয়ের স্টকব্রোকার আনন্দ শাহ তার ছয় বছরের ছেলে কারনিত অপহৃত হবার পর ফেসবুকে সাহায্য চেয়ে  প্রচারণা শুরু করেন। শাহ বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি আমার টেলিফোন নম্বর এবং কারনিতের ছবি পোস্ট করি এবং এ ব্যাপারে  জনগণের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।

ফেসবুকে সাহায্য চেয়ে আবেদনের কয়েক দিনের মধ্যেই সহমর্মিতা জানিয়ে বেশ কয়েকশ’ ব্যবহারকারী সাড়া দেয়। এর ফলে ফেসবুকে করা এই আবেদনটি একটি অনলাইন প্রচারণায় রূপ নেয়।

অবশেষে অপহৃত কারনিতের উদ্বিগ্ন পিতার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় অপহরণের ঠিক ১০ দিন পর। অপহরণকারীদের একজন তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে ছেলের মুক্তির জন্য এক কোটি রুপি দাবি করে। তবে শাহ একই সঙ্গে মুম্বাই পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছিলেন। মুম্বাই পুলিশ তার ফোনে আসা সব কলের ওপর নজর রাখছিল।

অপহরণকারীদের ফোনকল সনাক্ত করে অবশেষে পুলিশ তাদের অবস্থান জানতে পারে এবং ‍অভিযান চালিয়ে উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে।

উদ্ধার অভিযানে একই সঙ্গে মুম্বাই পুলিশের অপরাধ দমন শাখা,উত্তর প্রদেশের সন্ত্রাস বিরোধী স্কোয়াড এবং এলাহাবাদ পুলিশ অংশ নেয়।

শিশু কারনিতের মতো একইভাবে দিল্লি থেকে অপহরণ হওয়া শিশু ইহসান সিংও উদ্ধার পায়।

তবে অপহৃত শিশুদের মধ্যে কারনিত বা ইহসানের মতো ভাগ্যবান খুব কম কমই আছে যারা মেষ পর্যন্ত অপহরণকারীদের খপ্পর থেকে মুক্তি পেয়েছে। বেশিরভাগ শিশুই আর কখনও ফিরে আসেনি।

এব্যাপারে উত্তর প্রদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক প্রকাশ সিং বলেন, জনগণের উচিৎ পুলিশকে তাদের আস্থায় নেওয়া। অপহরণের ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর উচিৎ অপহরণকারীদের সঙ্গে দর কষাকষিতে যতো বেশি সম্ভব সময় পার করা। এর ফলে অপহরণকারীদের খুঁজে বের করা পুলিশের জন্য সহজ হবে।

এ হলো ভারত চলমান অপহরণ আতংকের কয়েকটি উদাহরণ আর এ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য। এবার দেখা যাক দেশটির অভিজাত শহরগুলোতে অপহরণের পরিসংখ্যান কতোটা উদ্বেগজনক। এতে বোঝা যাবে কর্তৃপক্ষ যতোই তাদের আন্তরিকতার কথা বলুক এসব অপরাধ যে ক্রমশঃ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে তা খুব স্পষ্ট।

সরকারি এবং বেসরকারি হিসেবে শুধু রাজধানী দিল্লীতেই ২০০৮ সালে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ২শ’ ৩৩টি। ২০১১ সালে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ৯শ’ ৭৫টিতে।

তবে শুধু মুক্তিপণের জন্য অপহরণের আলাদা কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

ভারতের কেন্দ্রীয় জাতীয় অপরাধ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০৯ সালে দেশজুড়ে ৩৩ হাজার ৮শ’ ৬০টি অপহরণের ঘটনা নথিভূক্ত করে। যেখানে ২০০৮ সালে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৩০ হাজার ২শ’ ৬১টি।

তাদের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ীই ২০০৮ থেকে ২০০৯ সাল এক বছরেই ভারতে অপহরণের ঘটনা বেড়েছে প্রায় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ।

পরিসংখ্যানে আরও দেখা গেছে, সবচে বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটে ভারতের জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ এবং সর্বাধিক অপরাধপ্রবণ রাজ্য বিহারে।

বাংলাদেশ সময়: ২২৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।