ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

একটি বানরের অসহায় মৃত্যু এবং...

আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:২৪, জানুয়ারি ১২, ২০১২
একটি বানরের অসহায় মৃত্যু এবং...

মাত্র কিছুক্ষণ আগেও সে বৈদ্যুতিক তারে আর আশপাশের বিল্ডিংয়ের দেয়াল-কার্নিশ বেয়ে স্বচ্ছন্দ্য অনায়াসে ছুটে বেড়িয়েছে। নিচে দাঁড়ানো মানুষের সঙ্গে সহজাত দুষ্টুমির ভঙ্গিসহ রাজকীয় সে চলাচলে গলায় জড়ানো স্টিলের শিকলটা পিঠের ওপর দিয়ে কায়দা করে লেজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখছিলো।

এ দৃশ্য দেখে নিচে দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথিকসহ আশপাশের ফেরিওয়ালারা হয়েছেন চমকিত, আনন্দিত।

বৃহস্পতিবার সকালেও সে দেখিয়েছে এমনি মজার নানান ভঙ্গি। প্রতিদিন খাবারের সন্ধানে এভাবে এখান দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করেছে সে তারখাম্বা আর বিল্ডিংয়ের দেয়াল-কার্নিশ বেয়ে ‘বান্দরামি করতে করতে’। monkey

কিন্তু এখন সে পড়ে আছে ফুটপাতের ওপরে, মুখ বেয়ে রক্ত পড়ছে টপ টপ করে, অচেতন- অর্থাৎ মারা যাচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। ঈষৎ ডানদিকে কাৎ শরীরে বুকের ওপর পড়ে আছে মুক্ত শিকল। এ শিকলটি কিছুক্ষণ আগেও তার গলায় আটকানো ছিল। গলায় পোড়া তামাটে দাগ। চামড়া পোড়ার গন্ধটা নাকে খুব লাগছিল। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকারা সবাই আফসোস করছিলেন। বেশিরভাগই পথচারী। দু’একজন আশপাশের-ফুটপাতের ফেরিওয়ালা। তারাই দিচ্ছিলেন নাম না জানা এই শাখামৃগটির ব্যাপারে অন্যদের ঔৎসুক্যের জবাব। আমি রিক্সা থামিয়ে এগিয়ে যাই।

যেহেতু গলায় শেকল, তাই প্রশ্ন- বানরের মালিক কে? নিশ্চয়ই কোনও খেলা দেখানেওয়ালা অর্থাৎ ‘বান্দরওয়ালা’র ‘বান্দর’ সে। কিন্তু অভিজ্ঞতায় বলে, খেলাদেখানেওয়ালা বানরের গলায় এত মোটা শেকল পড়ানো থাকে না। যে ব্যক্তি তাকে শেকলটি পড়িয়েছেন, তার বিবেক আর মস্তিষ্ক দু’টোই ওই শিকলের চেয়েও নিরেট আর ভারী নিঃসন্দেহে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এটি একটি মুক্ত বানর ছিল অর্থাৎ অধুনা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে আসা ঢাকার নাগরিক বানরদের একজন ছিল প্রানীটি। কোনো কারণে মানুষের খোলসে থাকা কোনো অমানুষ তাকে বন্দি করেছিল।

কিন্তু, স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়! তাই সুযোগ বুঝে শিকল ছিঁড়ে পালিয়েছিল সে। তবে মুক্ত-স্বাধীন হলেও চরাচরের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী মানুষের প্রযুক্তি আয়ত্বে না থাকায় চূড়ান্ত মুক্ত হতে পারেনি শিকলের দায় থেকে।

monkeyবৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার কিছু ‍আগে রাজধানীর মিরপুর রোডে ঢাকা কলেজের সামনের একটি তারখাম্বার ওপর থেকে (প্রায় ৫০ ফুট) মাটিতে আছড়ে পড়ে সে। গলায় পেঁচানো শেকলটি বিদ্যুতায়িত তারের সংস্পর্শে আসার পর নড়ক যন্ত্রণা ভূগতে হয় তাকে। বিদ্যুৎস্পর্শে গলার সামনের অংশে আগুন ধরে যায়। পুড়ে যায় মোটা চামড়া-মাংশ। এরপর ধপাস করে অত ওপর থেকে পড়ে মাটিতে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাতে গলগল করে বেড়িয়ে আসে রক্ত।

সে দৃশ্য আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম অসহায়ের মত। বানরটির মুখের দিকে চেয়ে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো- ইস্, ঠিক মানুষের মত কষ্ট আর মায়ামাখা একটি মুখ!

[উল্লেখ্য, (সম্ভবত) রেসাস প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় এ বানরগুলো পুরনো ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় এখনও দেখা যায়। চলাফেরা, জীবন-যাপন আর  আচার আচরণে এদের অসাধারণ নাগরিক সচেতনতা আর মানবিক আবেগ আশপাশের মানুষকে প্রায়ই অবাক করে। ]
 
বানরটিকে বাঁচানোর কোনও উপায় নিশ্চিতভাবেই ছিল না। এই শহরে সংকটাপন্ন মানুষকে বাঁচানোই যেখানে দুষ্কর, সেখানে একটি তুচ্ছ ‘বান্দর’...!

তবে আমি রিক্সা থেকে নেমে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাদের দলে যোগ দেওয়ার পর থেকে ভাবছিলাম সেই অমানুষটির কথা- যে তাকে এভাবে শেকলবন্দি করেছিল। তিনি এখন কোথায়? হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় মশগুল, কিংবা সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করছেন পরম যত্নে, অথবা ব্যস্ত রয়েছেন রুটি-রুজির কাজে! কিন্তু তার নিতান্ত অবহেলায় ভরা দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি কাজের কী ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে এই নিরপরাধ অবলা প্রানীটিকে- তা যদি তিনি একবার দেখতেন!  

জানি, এ ঘটনায় কোনও মামলা হবে না, হবে না কোনও শোক বা প্রতিবাদসভা। monkey
 
তবে আমি, বৃহস্পতিবার দুপুরের ওই মর্মান্তিক সময়ে ঢাকা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বা পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সব ব্যথিত মানুষের পক্ষে সেই অমানুষ মানুষটিকে অভিশাপ দিচ্ছি- না অভিশাপ না, প্রার্থনা করছি তার এবং তার মত আরও সব নিষ্ঠুর মানুষদের সুমতির জন্য।

কারণ, হরহামেশা তাদের অপরিণামদর্শী আচরণের গোনাগারি দিতে হয় পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি নিরপরাধ আদমসন্তানসহ অবলা অসহায় প্রাণীকূলকেও। তাদের মত বিকৃত মনাদের কারণেই সৃষ্টি হয় সভ্যতার কলংক হিরোশিমা-নাগাসাকি, হোলোকাস্ট, ইরাক-আফগানিস্তান। আমাদের আশপাশে ঘাপটি মেরে থাকা এই অসুরদের দমন করতে না পারলে ফুটপাতে পড়ে থাকা অসহায় বানরের লাশটির মত সমগ্র মানবসভ্যতাও একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে এভাবে, দুঃখ প্রকাশেরও কেউ থাকবে না।

বাংলাদেশ সময়: ২৩১৩ ঘণ্টা, ১২ জানুয়ারি, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।