ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

চাটমোহরে এক শাহ্জাদা’র মসজিদের গল্প

শামীম হাসান মিলন, চাটমোহর প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:০৩, জানুয়ারি ১৬, ২০১২
চাটমোহরে এক শাহ্জাদা’র মসজিদের গল্প

চাটমোহর (পাবনা) : গভীর রাত। চারদিক সুনসান।

বাঁশির মোহিনী সুর মূছর্না ভেসে আসছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে স্রষ্টার প্রশংসা সূচক ধ্বনি সে সুরে। মন্ত্রমুগ্ধ সে সুর বিছানা ছাড়তে বাধ্য করে বাঙলা বিহারের শাসনকর্তা শেরশাহ’র ধর্মান্তরিত বেগমকে।

বাঁশির সুর অনুসরণ করে সৈন্যদের ঘাঁটির ডেরা থেকে পাশেই এক দরবেশের আস্তানায় হাজির হন শেরশাহ’র ব্রাহ্মণ স্ত্রী। তন্ময় হয়ে বাঁশিতে স্রষ্টার প্রশংসা গীতি শুনতে থাকেন। ঘুম ভাঙলে শয্যাপাশে বেগমকে না পেয়ে তরবারি হাতে বেগমকে খুঁজতে বের হন বাদশা। দেখতে পান বেগম দরবেশের আস্তানায় নিবিষ্ট মনে বাঁশি শুনছেন।

তখন দরবেশের কাছে বেগমের আগমনের কারণ জানতে চান বাদশা। দরবেশ মৃদু হেসে ইঙ্গিতে বেগমকে নিয়ে যেতে বলেন। এ ঘটনায় দম্ভী বাদশার স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ ও ক্ষোভ দেখা দেয়।

স্ত্রীকে ত্যাগ করে শেরশাহ্ ফিরে যান দিল্লীতে। এটি কি নিছক গল্প? এর সত্যাসত্য মেলানো ভার, তবে এর রয়েছে লেখ্য ইতিহাস। আর জনশ্রুতিও।

পাবনার চাটমোহর উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে (বড়াল ও গুমানী নদীর ৩টি ঘাট পার হয়ে) নিমাইচড়া ইউনিয়নের এককালের মোঘল-পাঠানদের ক্রীড়াভূমি প্রাচীন জনপদ ‘সমাজ গ্রাম’ এর মানুষের মুখেমুখে এখনও ফেরে সে গল্প-কল্প কাহিনী। (লেখ্য সূত্র: রাধারমন সাহা বিএল এর জিলা পাবনার ইতিহাস, প্রমথনাথ বিশীর চলনবিল ও অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ টিকে এর চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থে এ কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে)।

জনশ্রুতি মতে ওই ঘটনার পর শেরশাহ সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা প্রেমিকা স্ত্রীকে ফেলে চলে যান। ধর্মকন্যা হিসেবে দরবেশ তার আস্তানায় বেগমকে স্থান দেন। যথাসময়ে তিনি একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেন। দরবেশ তার নাম রাখেন শাহ্জাদা সুলতান সেলিম। বড় হলে সেলিমকে সমাজ গ্রামের এক পার্সি টোলে ভর্তি করা হয়।

সহপাঠিরা তার পিতৃ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলো। সেলিম তার মাকে জানায়। তখন তার মা জানায়, তার পিতা দিল্লীর সম্রাট শেরশাহ্।

শাহজাদা সেলিম আরও বড় হয়ে পিতাকে দেখার জন্য মাকে দেয়া বাদশার উপহার একটি কবজ নিয়ে দিল্লী যান। অনেক কষ্টে ও চেষ্টায় শাহজাদা সম্রাটের দরবারে হাজির হয়ে মায়ের দেয়া কবজটি দেখিয়ে আত্মপরিচয় দেন।

শেরশাহ্ সেলিমকে নিজের পুত্র পরিচয় স্বীকার করে তাকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করেন এবং রাজ কর্মচারি পাঠিয়ে বেগমকে দিল্লী নিয়ে যান। এর কিছুদিন পর বেগম মারা যান। শাহ্জাদা সুলতান সেলিম দরবেশের আহ্বানে আবার সমাজ গ্রামে ফিরে আসেন। দরবেশের নির্দেশে সমাজ গ্রামে মসজিদ নির্মাণ করেন।

লোকশ্রুতি ও লেখ্য ইতিহাস মতে এই দরবেশই হযরত আশরাফ জিন্দানী (রহঃ)। এ দেশে ইসলাম প্রচারে সে সময় যে বারো আউলিয়া আগমন করেন, তিনি তাদেরই একজন ছিলেন।

পাবনা জেলা গেজেটিয়ারের ৯৯ পৃষ্ঠায় ও প্রমথনাথ বিশীর চলনবিল গ্রন্থের ১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, সমাজ গ্রামটি সে সময় এক সমৃদ্ধ জনপদ ছিলো।

গ্রামটিতে ছয় বুড়ি পুকুর আর নয় বুড়ি গাড়া আছে। সে গুলোর সবই পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। সাড়ে ৪০০ বছর আগে শাহজাদা সেলিমের মসজিদ এবং ‘সমাজ শাহী মসজিদ’ নামে পরিচিত ৯৫৮ হিজরীতে (১৫৪৯ খৃস্টাব্দে) নির্মিত হয়। মসজিদটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ প্রায় সমান। প্রাচীন স্থাপত্যকলার নির্মাণ শৈলী মসজিদটিকে দৃষ্টি নন্দন করে রেখেছে।

মূল ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট ক্ষুদ্র জাফরি ইটের মসজিদটির ৪ কোনায় আরও ৪টি ছোট স্তম্ভ গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির ভেতরে ও বাইরের দেয়ালে দু`টি কৃষ্ণবর্ণের পাথরে পবিত্র কোরআনের আয়াত খোদাই করা ছিলো। ১৯৪২ সালে শিলালিপি দু’টি ভারতীয় জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

মসজিদ লাগোয়া দক্ষিণ-পূর্ব কোনে রয়েছে হযরত আশরাফ জিন্দানী (রহঃ) এর মাজার। আর এর পাশেই রয়েছে ২২ বিঘা আয়তনের বিশাল একটি দীঘি। এই দীঘিটি মসজিদের আগেই নির্মাণ করা হয়েছিলো।

মসজিদটি ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হলে ১৩০৯ বঙ্গাব্দে সিরাজগঞ্জের শাহ্জাদপুরের মহিউদ্দিন, সমাজ মিয়াপাড়ার মোমিন উদ্দিন মাস্টার ও রমজান মাস্টার গ্রামবাসীর সহযোগিতায় সংস্কার করেন। মসজিদ ও মাজারের আয়তন প্রায় ৩০ বিঘা। এর মধ্যে দীঘিটিই ২২ বিঘা। ওয়াকফ স্টেট হিসেবে এটি পরিচালিত হচ্ছে।

এর মোতোয়াল্লী আলাউদ্দিন ফকির বাংলানিউজকে জানান, মাজার চত্বরে ১৯৭৫ সালে একটি হাফিজিয়া, ২০০০ সালে একটি দাখিল মাদ্রাসা চালু করা হয়েছে। এছাড়া ২০০৭ সালে একটি ধর্মীয় পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে।

মসজিদের ইমাম মিয়াপাড়া গ্রামের নাসির উদ্দিন জানান, ২০০৮ সালে মসজিদের ভেতরে মেঝে ও দেয়ালে টাইলস্ বসানো হয়েছে।

এছাড়া সমাজ বাজারের পাশে ১৯৭৩ সালে হযরত আশরাফ জিন্দানী (রহঃ) উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এ গ্রামের কৃতী সন্তান মরহুম অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক সমাজী (সাবেক এমপি)। তার কবরটিও মাজারের পাশে রয়েছে।

ওই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোফাজ্জল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, প্রতি শুক্রবার এখনো দূর-দূরান্তের ধর্মপ্রাণ শত শত মানুষ মাজারে খাসি, মুরগি, মিষ্টি মানত দিতে আসে। অনেকে খিচুড়ি রান্না করে গ্রামবাসীর মাঝে বিতরণ করে।
 
মাজারের হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রধান হাফেজ আব্দুল বারী জানান, প্রতি বছরের বাংলা মাঘ মাসের তৃতীয় শুক্রবার থেকে ৩ দিন মাজারে ওরস হয় এখনও।

তিনি জানান, মাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দূরেই রয়েছে শিতলাই জমিদার যগেন্দ্রনাথ মৈত্র এর কাছারি বাড়ি। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখনো ভ্রমণ পিপাসু মানুষ মাজার ও জমিদার বাড়ি দেখতে আসেন।

বাংলাদেশ সময় : ১২৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।