যশোর: দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল...।
মধুকবির গভীর আবেগমথিত এ আহ্বানে সাড়া দিতে সারাবছরই মুখিয়ে থাকে বৃহত্তর যশোরসহ সারাদেশের সাহিত্যানুরাগী মানুষ।
২৫ জানুয়ারি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্থপতি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৮৮ তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়িতে ২১ জানুয়ারি শুরু হয়েছে ৭ দিনের ‘মধুমেলা’।
মেলায় এখন উৎসবের আমেজ। মেলা উপলক্ষে সাগরদাঁড়ি সেজেছে নতুন সাজে। মহাকবির জন্মভিটা দেখতে ছুটে আসছেন কবির হাজারও ভক্ত-অনুরাগী। কবির বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষেই বসেছে লোকজ দ্রব্যের পসরা।
সাগরদাঁড়ি মাইকেল মধুসূদন ইনস্টিটিউশনের মাঠজুড়ে মেলার আয়োজন। ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০০টি স্টল। লোকজ মেলার সব উপাদানই আছে এ আয়োজনে।
কুটির শিল্পের স্টলে শোভা পাচ্ছে কেশবপুরের কারুপল্লীর কাঠের তৈরি ফুলদানি, কলমদানি, পুতুল, ছোট হাঁড়িসহ নানা জিনিসপত্র। এ ছাড়া গ্রামীণ পণ্যের সমাহার তো রয়েছেই।
মেলায় জেলা পরিষদ নির্মিত মধুমঞ্চে প্রতিদিন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। এ ছাড়া মেলা মাঠের পাশ দিয়ে যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ, জাদু প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থেকে এসেছেন আব্দুর রশিদ। আসবাবপত্রের ব্যবসা তার। তার মত আরও ১০-১২ জন এসেছেন আসবাবপত্রের পসরা নিয়ে। খাট-পালঙ্ক, মিডশেফ, শোকেস ইত্যাদি নিয়ে। দামও ধরা হয়েছে ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে।
মেলায় আসা মধুভক্ত রকিব হোসেন বাংলানিউজকে জানান, আমরা শুনেছিলাম এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেলার উদ্বোধন করবেন। তবে তিনি এলেন না।
মধুসূদন সম্পর্কে জানার জন্য উপজেলা প্রশাসন মধুমঞ্চের পাশে এবারই প্রথম একটি স্টলে কবির সাহিত্যকর্ম, জীবনীসহ নানা বিষয়ে প্রজেক্টরের মাধ্যমে দর্শকদের দেখানো-জানানোর ব্যবস্থা করেছে।
মেলার সদস্য সচিব ও কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজা-উন-নবী বাংলানিউজকে জানান, মেলা সফল করতে যা যা করা দরকার, তা করা হয়েছে।
অপসংস্কৃতি বা কোনো ধরনের অশ্লীলতা এখানে করতে দেওয়া হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মেলায় প্রতিবারের মত এবারও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকবে’।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িটি প্রতœতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে। এখানে তৈরি করা হয়েছে মধুপল্লী। বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে কবির আবক্ষ মূর্তি। উঠোনে জমিদারবাড়ির ঠাকুরঘর। প্রতিটি ঘরে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র ।
কবির বাড়ির পূর্ব ও পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর সামনেই রয়েছে স্মৃতিময় বাদামগাছ। যেখানে বসে কবিকে ভাবিয়ে তুলত, তাঁর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এর পেছনে রয়েছে বিদায়ঘাট।
মধুসূদন কলকাতা থেকে স্ত্রী হেনরিয়েটা, সন্তান মেঘনাদ মিল্টন দত্ত ও শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তবে জমিদার বাবা তাকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেননি। জনশ্রুতি রয়েছে, তিনি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে তিন দিন ধরে এখানে অবস্থান করেন। মধুসূদন ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন, মারা যান ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন।
প্রতিবছর মধুকবির জন্মদিন ২৫ জানুয়ারি থেকে এ মেলা শুরু হয়। তবে এবার এসএসসি পরীক্ষার কারণে ৪দিন এগিয়ে আনা হয়েছে মেলা। ২৮ জানুয়ারি মেলা শেষ হবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এই মেলার পৃষ্ঠপোষকতা করছে মোবাইলফোন অপারেটর বাংলালিংক।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ মহাকাব্য।
তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি: দ্য ক্যাপটিভ লেডি, শর্মিষ্ঠা, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, হেকটর বধ [২] ইত্যাদি।
মাইকেলের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় তার করুণ মৃত্যু হয়। তার জন্ম হয় সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক হিন্দু পরিবারে।
পরবর্তীতে হিন্দু (পরে নাম প্রেসিডেন্সি) কলেজে পড়ার সময় তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। এসময় তার নামের আগে ‘মাইকেল যুক্ত হয়। ইংরেজি ভাষায় মহাকাব্য লিখতে উদ্যত মধুসূদনকে বাংলায় লিখতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন বেথুন সাহেব।
জমিদারের ছেলে হয়েও তিনি পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। ফ্রান্সে থাকাকালীন অর্থাভাবে জর্জরিত মধুসূদনকে টাকা পাঠিয়ে সাহায্য করতেন তার বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
কবি তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে জন্মভূমির প্রতি গভীর ভালবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন। তার সমাধিস্থলে নিচের কবিতাটি লেখা রয়েছে:
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে!
তিষ্ঠ ক্ষণকাল!
এসমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে
যেমতি বিরাম)মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্ত কূলদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন!
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১২