ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

দুর্লভ ঐতিহ্যের ধারক রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র জাদুঘর’

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০২১
দুর্লভ ঐতিহ্যের ধারক রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র জাদুঘর’ ‘বরেন্দ্র জাদুঘর’, ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: দুর্লভ ঐতিহ্যের ধারক রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র জাদুঘর’। এটি দেশের প্রথম জাদুঘর এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা।

দুষ্প্রাপ্য সব প্রত্নসম্পদ নিয়ে আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে এ জাদুঘর। যুগের পর যুগ ধরে প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে আসছে।

রাজশাহী মহানগরের প্রাণকেন্দ্র হেতমখাঁ সদর হাসপাতালের সামনে অবস্থিত প্রাচীন সংগ্রহশালা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা এ জাদুঘরে উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের পাল, সেন, মৌর্য ও গুপ্ত আমলসহ হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সংরক্ষিত করে রাখা আছে। তাই প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে আসেন ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাড়াও দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীরা আসেন পরিদর্শনের জন্য। তবে করোনা পরিস্থিতির জন্য গেল বছরের মার্চ মাস থেকে সর্বসাধারনের দর্শনের জন্য বরেন্দ্র জাদুঘর বন্ধ রাখা হয়েছে। কেবলমাত্র গবেষণা কাজ ও ভিআইপি দর্শনার্থীদের জন্য বরেন্দ্র জাদুঘর খোলা রাখা হয়েছে।

রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত। তাই করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে বরেন্দ্র জাদুঘরও সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বরেন্দ্র জাদুঘর খোলা থাকে। দর্শনার্থী না থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আবারও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হবে জাদুঘর।

পাশের জেলা নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের বিদ্যোৎসাহী জমিদার কুমার শরৎকুমার রায়, খ্যাতনামা আইনজীবী ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ্রের প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে তৎকালীন সচেতন মহল ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেন, যার ফলে বিস্মৃত প্রায় সাহিত্যিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংগ্রহ ও অনুশীলনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১৯০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের কাশিমবাজার পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  

পরের বছর পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন হয় ভাগলপুরে। শরৎকুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও রমাপ্রসাদ উভয় অধিবেশনে যোগ দিয়ে বরেন্দ্রভূমির পুরাকীর্তি সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং পুরাকীর্তি সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠেন। ১৯১০ সালে তারা বগুড়া জেলার খঞ্জনপুরে পুরাতাত্ত্বিক অভিযানে যান এবং এর ঐতিহ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য একটি সমিতি গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে গঠন করেন বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি।

সমিতি অনুসন্ধান চালিয়ে রাজশাহী জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে কালো পাথরের বিখ্যাত গঙ্গা মূর্তিসহ পুরাতত্ত্বের ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করে। সমিতির সম্পাদক রামপ্রসাদ চন্দ সমুদয় নিদর্শন প্রধানত পুরনো স্থাপত্যের নিদর্শন, পুরনো ভাস্কর্যের নিদর্শন ও পুরনো জ্ঞান ধর্ম সভ্যতার নিদর্শন (যেমন পুঁথি) এ তিন ভাগে বিভক্ত করেন।  

কুমার শরৎকুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও রমাপ্রসাদ সমিতির ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যক্তিগত যে অর্থ দেন তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম। তৎকালীন বঙ্গীয় সরকার সমিতিকে ১০০ টাকা করে অনুদান দিত। এ আর্থিক অনটনের মধ্যে সংগৃহীত নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘর ভবন নির্মাণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে এবং তা ব্যয়বহুল জানা সত্ত্বেও শরৎকুমার বন্ধুদের অনুরোধে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সমিতির কর্মকর্তাদের অনুরোধে তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।  

নির্মাণ শেষে ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর দ্বার উন্মোচন করেন লর্ড রোনাল্ডসে। ১৯৪৭-এর পর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর মারাত্মক দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে, যার ফলে এটি রক্ষা ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনে ১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর হস্তান্তর করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে।  

বর্তমানে এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধীন। ১৯১১ সালে কলকাতা জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘরের যাবতীয় সংগ্রহ দাবি করেছিল। ফলে এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের কমিশনার এফ জে মনোমোহনের প্রচেষ্টায় বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল বরেন্দ্র জাদুঘর পরিদর্শনে এসে সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন। ১৯১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সরকারি সার্কুলারের মাধ্যমে স্থানীয় জাদুঘরগুলোকে সংগ্রহের বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া হলে এ জাদুঘরের অস্তিত্ব রক্ষা হয়।  

বরেন্দ্র জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আলী রেজা মুহম্মদ আব্দুল মজিদ বাংলানিউজকে জানান, জাদুঘরের সংগ্রহে বর্তমানে পাণ্ডুলিপিসহ ১১ হাজার ৩৩১টি প্রত্ননিদর্শন রয়েছে। গ্যালারি রয়েছে ১৪টি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাদুঘর থেকে বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার দুর্লভ প্রত্নসামগ্রী। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত জাদুঘরের পূর্ণাঙ্গ ইনভেন্টরি প্রতিবেদনে জাদুঘরের প্রত্নসম্পদ হারানোর বিষয়টি উঠে আসে। জাদুঘরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সুলতান আহমদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল ওই ইনভেন্টরি তৈরি করে। এতে ১৯১০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১০০ বছরে সংগৃহীত ও হারানো প্রত্নসম্পদের তথ্য প্রকাশিত হয়।

ইনভেন্টরি প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত হারিয়েছে ১৮৫টি প্রত্নসামগ্রীসহ প্রায় তিন হাজার দুর্লভ বস্তু। জাদুঘরের নিবন্ধিত নানা ধরনের প্রত্নসামগ্রীর ১৮৫টির কোনো হদিসই নেই। হারিয়ে যাওয়া প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- দু'টি ব্রোঞ্জ, দু'টি কপার, দু'টি লিনেন, একটি ব্রাশ, দু'টি সিলভার, একটি ক্রিস্টাল, ৪৭টি বিভিন্ন ধরনের পাথর, ১০১টি টেরাকোটা, ১৩টি কাগজ ও দু’টি প্রাণীর চামড়া। এছাড়া পাঁচ হাজার ৯৭১টি নিবন্ধিত মুদ্রার মধ্যে ৩৩টি ও ১৩ হাজার ৯৩৩টি গ্রন্থের মধ্যে ৮৫টি পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না ১৩ হাজার ৫৭৬টি প্রকাশনার (পুস্তক, পুস্তিকা, গ্রন্থ, জার্নাল ইত্যাদি) মধ্যে তিন হাজার ৫২টি।  

তবে জাদুঘরের এ পর্যন্ত সংগ্রহ সংখ্যা সাড়ে আট হাজারেরও বেশি। এরমধ্যে প্রায় দেড় হাজার প্রস্তর ও ধাতবমূর্তি, ৬১টি লেখচিত্র, দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন মুদ্রা, ৯০০’র বেশি পোড়ামাটির ভাস্কর্য-পত্র-ফলক, প্রায় ৬০টি অস্ত্র-শস্ত্র, ৩০টির মতো আরবি-ফার্সি দলিল, মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকারের রৌপ্য-ব্রোঞ্জ-মিশ্র ধাতুর প্রায় ৪০০টি মুদ্রা রয়েছে এখানে। এছাড়া প্রায় সাড়ে চার হাজারেরও বেশি পাণ্ডুলিপি আছে। এসব সংগ্রহ মোট ১৪টি গ্যালারিতে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।

বরেন্দ্র জাদুঘরের এক নম্বর গ্যালারিতে রয়েছে প্রচীন আমলের ঢাল-তলোয়ার, ধাতবপাত্র, মহেঞ্জোদারো ও মহাস্থানের বিভিন্ন নিদর্শন। সম্রাট অশোক থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত কাঠ, পাথর ও অন্য বস্তু দ্বারা নির্মিত মূর্তিগুলো প্রদর্শিত হয়। দুই নম্বর গ্যালারি সূর্য, বিষ্ণ, শিব, কার্তিক ও অন্য দেবতার মূর্তি, পার্বতী, সরস্বতী, মনসা দুর্গা ও অন্য দেবীর মূর্তি। তিন নম্বর বুদ্ধ গ্যালারিতে সব বুদ্ধ দেব-দেবী ও জৈন মূর্তি, বোধিসত্ত্ব, ঋসভনাথ, পর্শ্বনাথ ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়।  

এছাড়া সেখানে প্রাচীন আমলের আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, বাংলা লেখচিত্র এবং পাল যুগ, সুলতানি যুগ, মোগল যুগের শিলালিপি ছাড়াও শেরশাহর দু’টি কামান ও মেহরাব প্রদর্শিত হচ্ছে। চার নম্বর ইসলামী গ্যালারিতে হাতে লেখা কোরআন শরীফ, মোগল আমলের ফার্সি দলিল, পোশাক মুদ্রা ইত্যাদি দিয়ে এ গ্যালারি প্রাচীন ঐতিহ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।

বর্তমানে পাঁচ নম্বর আবহমান বাংলা গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হচ্ছে বাঙালি জাতির ব্যবহার্য জিনিসপত্র, প্রাচীন গহনা, দেশি বাদ্যযন্ত্র, আনুষ্ঠানিক মৃৎপাত্র, উপজাতিদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। কিশলয় বেষ্টিত নদীমাতৃক বাংলার নৌকার মডেল, অস্ত্রের সূর্য নরম সোনালি রোদ ছড়িয়ে জন্মভূমিকে করেছে অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে সেই চিত্র ফুটে ওঠে।  
 
বরেন্দ্র জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক ড. আলী রেজা মুহম্মদ আব্দুল মজিদ বাংলানিউজকে বলেন, জাদুঘরের নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বিষয়টি এখন সিন্ডিকেট সভায় পাস হওয়ার অপেক্ষায় আছে। করোনার কারণে প্রস্তাবনাটিও পাসের জন্য অপেক্ষায় আছে।

সিন্ডিকেটে পাস হলে শিগগিরই নতুন অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলেও প্রত্যাশার কথা জানান বরেন্দ্র জাদুঘরের পরিচালক।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০২১
এসএস/আরবি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।