ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

নেতাজি, তোমায় অভিবাদন

আশরাফুল ইসলাম, সংবাদকর্মী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:৫২, জানুয়ারি ২৩, ২০১২
নেতাজি, তোমায় অভিবাদন

১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ভারতের ওড়িষ্যার কটকে জানুকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবী দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম হয় এক শিশুর। বাবা-মা নাম রাখেন সুভাষ চন্দ্র বসু।

বড় হয়ে যে একটি পরাধীন রাষ্ট্রের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন, অভিবাবকদের কাছে তেমন লক্ষণ ধরা পড়ে সুভাষের কলেজ জীবনেই। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক ওটেনের ভারত বিদ্বেষী বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করায় কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন সুভাষ। পরবর্তীতে এই সুভাষই হয়ে ওঠেন কোটি ভারতবাসীর প্রিয় নেতাজি।
 
কেবল অবিভক্ত পরাধীন ভারতের নয়, সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠে আজও সমান শ্রদ্ধা-আবেগ আর গভীর ভালবাসায় উচ্চারিত হয় তাঁর নাম।

আজ ২৩ জানুয়ারি, অবিসংবাদিত এই নেতার ১১৬ তম জন্মদিন। ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার মহান ব্রত নিয়ে নেতাজির আলোচিত দেশত্যাগের পর তার অমীমাংসিত তথাকথিত মৃত্যু ১৯৪৫ এর ১৮ আগস্ট। সে হিসেব মতে, তিনি গত হয়েছেন ৬ যুগেরও বেশি সময় আগে। তারপরও লক্ষকোটি নির্যাতিত, নিপীড়িত, গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য আজও তিনি সমানভাবে অপরিহার্য।

বিশেষ করে, বর্তমান বিশ্বের পশ্চিমা দেশগুলোর চলমান সম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এখনও নেতাজির দেশপ্রেমের আদর্শ আর আত্মত্যাগ-আমাদের প্রেরণা যোগায়, উদ্বেলিত করে-শক্তির সঞ্চার করে অন্যায়কে রুখে দিতে।

স্কুল জীবনে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় শহীদ বেলাল পাঠাগার-নামে একটি সম্বৃদ্ধ গ্রন্থাগারের সাথে আমার সখ্য গড়ে উঠে। বই,পত্র-পত্রিকা পড়া ছাড়াও মফস্বল শহরের এ গ্রন্থাগারের মাধ্যমে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলে। এ গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা আমার পরম শ্রদ্ধেয় শাসছুল হক, যিনি দীর্ঘ সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত রেখেছেন নিজেকে, কাজ করেছেন একাধিক জাতীয় দৈনিকে; সর্বশেষ কাজ করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের হয়ে। নিয়মিত লাইব্রেরি ওয়ার্কের কাজে একদিন পাঠাগারে বসেই পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখছিলাম। পাশের ছোট্ট একটি কক্ষে বইয়ের স্তূপের ভিতর কয়েকজন বিদগ্ধ বয়োজ্যেষ্ঠ পাঠকদের নিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন শামছুল হক। কাজ করতে করতেই তাদের মুখে শুনছিলাম নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের নানা গল্প। বিষয়টি সেদিন আমার মনে সঞ্চার করেছিল নতুন আবেগের।  
পরে নেতাজি ভক্ত শ্রদ্ধেয় শামছুল হককে যখনই একা পেয়েছি, তখনই প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে জানতে চেয়েছি নেতাজির বিরল দেশপ্রেম, সংগ্রামী জীবন আর অন্তর্ধান রহস্যের নানা কথা। এই সময়ে এসে নেতাজিকে নিয়ে আমার অপরিমেয় অনুরাগের শুরুটা এভাবেই।
 
পরবর্তীতে যতবার নেতাজিকে জানবার চেষ্টা করেছি, ততবার শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছি।

নেতাজি গবেষক ও ঐতিহাসিকদের তথ্য থেকে জানা যায়, কলেজ জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের রচনা দারুণভাবে উদ্বেলিত করে সুভাষকে। প্রখর মেধাবী সুভাষ চন্দ্রের রাজনীতিতে আসা বন্ধু হেমন্তকুমারের হাত ধরেই। ১৯১৪ সালে সুভাষ শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখা করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে। কবির কাছে তরুণ এ নেতা দীক্ষা নেন গ্রাম পুনর্গঠনের। দেশে তখন চরম উত্তেজনা। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তুখোর মেধাবী পরে আইসিএস পাস করেও ব্রিটিশদের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে কাজে যোগ দিলেন না।

আজন্ম দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের অনুপ্রেরণায় দেশে ফিরে যোগ দিলেন কংগ্রেসে। নেতৃত্বদানের অসাধারণ যোগ্যতায় সুভাষ বসু দু’বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩০-এ লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুলেন সুভাষ। বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতা জন্য আপোষহীন এই নেতা কারাবরণ করতে হয় এগার বার। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে গান্ধিজীর সাথে বিরোধে জড়ান সুভাষ বসু। তিনি বিশ্বাস করতেন, কেবল অহিংস আন্দোলন করে স্বাধীনতা লাভ সম্ভব নয়, তার জন্য চাই স্বশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। তাই কংগ্রেস ছেড়ে গঠন করেন ফরোয়ার্ড ব্লক নামে নতুন রাজনৈতিক দল।   কবি নজরুল নেতাজির রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখলেন, ‘ধর্মগুরু ধর্ম শোনান/পুরুষ ছেলে যুদ্ধে চল্।
নেতাজির অসাধারণ নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা আর দেশপ্রেম মুগ্ধ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও। কবিগুরু নেতাজির নামে উৎসর্গ করেন তাঁর ‘তাসের দেশ’ নাটিকা। উৎসর্গ পত্রে কবি লিখলেন, ‘স্বদেশের চিত্তে নুতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছে, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম। ’
 
কংগ্রেস ছেড়ে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে এক জনসভায় নেতাজি ঘোষণা করলেন, ‘আর নয়, অনেক হয়েছে। শুধু টালবাহানা করেই সাতটা অমূল্য বছর কেটে গেছে। এবার চাই আপোসহীন সংগ্রাম এবং এ সংগ্রাম শুরু করবে ফরোয়ার্ড ব্লক। ’
সুভাষের ডাকে জেগে উঠে নবীন ভারতবর্ষ। দলে দলে বিপ্লবী আর সংগ্রামী মানুষ জড়ো হতে থাকলো নেতাজির পাশে। এক পর্যায়ে নেতাজিকে অন্তরীণ করা হলো কলকাতার এলগিন রোডের মেজদাদা শরৎ বসুর বাড়িতে। ইউরোপ জুড়ে তখন যুদ্ধের ডামাডোল। ইংরেজদের বিপর্যস্ত করার এমন সুযোগ হাতছাড়া করা সমীচীন মনে করলেন না সুভাষ চন্দ্র। শুরু করলেন গোপনে দেশত্যাগের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।
 
ঊনিশ শ’ একচল্লিশের ষোল জানুয়ারি দিবাগত রাতে ভাইপু শিশির বসুর সহায়তায় দেশত্যাগ করেন নেতাজি। আফগানিস্তান, তুরস্ক, রাশিয়া হয়ে জার্মানিতে পৌঁছান নেতাজি।
জার্মানি থেকে চলে যান জাপানে। এখানেই বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর অনুরোধে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। জাপান সরকারের সহায়তায় নেতাজি গঠন করেন ‘প্রবাসী আজাদ হিন্দ’ সরকার। অক্ষশক্তির ৯টি দেশ স্বীকৃতি দেয় এ সরকারকে। আজাদ হিন্দ বাহিনী ইমফল ও বার্মায় ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
 
নেতাজি আশা করেছিলেন, ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আজাদ হিন্দ বাহিনীর আক্রমণের খবর শুনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যরা যোগ দেবে তাঁর বাহিনীতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবে তেমনটা ঘটলো না। জাপানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজও বাধ্য হয় আত্মসমর্পণে। নেতাজির যুদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে বিকল্প পথের সন্ধানে বেরিয়ে আর ফেরেননি তিনি।
 
কারও মতে, রাশিয়ার কাছে বন্দি অবস্থায় সাইবেরিয়াতে মৃত্যু হয় নেতাজির। সরকারি মতে, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘ্টনায় মৃত্যু হয় তাঁর। নেতাজির মৃত্যু রহস্য উন্মোচনে সরকারি-বেসরকারিভাবে একাধিক কমিটি গঠন করা হলেও এখনো মীমাংসিত হয়নি নেতাজির বহুল আলোচিত অন্তর্ধান রহস্য।
 
সেই সময় নেতাজির অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলে পুরো বিশ্বকে। মুক্তিকামী ভারতবাসীকে সেসময় কতটা উদ্বেলিত করেছিল নেতাজির সংগ্রাম তার নজির ইতিহাসে বিরল। ভারতবাসীর উদ্দেশে তাঁর বিখ্যাত সে উক্তি, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব (তুম মুঝে খুন দো, ম্যায় তুমহে আজাদি দুঙা)।
 
উত্তাল সেই  সময়ে ১৯৪৪ এর জানুয়ারিতে রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ সরকারের এক প্রকাশ্য জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। নেতাজিকে নিয়ে লেখা ‘সুভাষ ঘরে ফেরে নাই’ গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী ওই জনসভায় ষাট হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল। নেতাজির প্রতি সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের কতটা প্রগাঢ় ভালবাসা ছিল তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ ওই জনসভা। জনসভায় নেতাজি তাঁর ভাষণে যুদ্ধের তহবিল সংগ্রহের ঘোষণা দিয়ে তাঁকে উপহার হিসেবে দেয়া একটি গোলাপ ফুলের মালা নিলামে তুলেন। নেতাজির আহ্বানে ওইদিন হরগোবিন্দ নামে এক স্বাধীনতাকামী সাত লাখ ডলার দামে জীবনের অর্জিত সকল সম্পদের বিনিময়ে কিনে নেন গোলপের সেই মালা। দেশপ্রেম আর নেতাজি অনুরাগের এ রকম হাজারো ঘটনা রয়েছে সেই সময়ে।
 
গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মতে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানকে নানা সময়ে খাটো করার প্রচেষ্টা হয়েছে, প্রচেষ্টা হয়েছে নেতাজির বিরল আত্মত্যাগের কথা ইতিহাসের পাতায় বিকৃতভাবে উপস্থাপনের। কিন্তু তা সফল হয়নি। এখনো কোটি ভক্তের হৃদয়ে অম্লান নেতাজির আদর্শ। ১১৬তম জন্মদিনে নেতাজির প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।


আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।