মিরপুর ১০, ডি ব্লক, মাঝখান দিয়ে প্রশস্ত রাস্তা চলে গেছে কালশীর দিকে। রাস্তার দু’পাশে ঝুটের (গার্মেন্টস্ কাটপিস) বাজার।
একটা সিঁড়ি নেমে গেছে মূল স্থাপনার দিকে, সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকতেই কানে এল ঘণ্টার ধ্বনি। তিন চারজন স্কুলপড়–য়া ছেলে ঘণ্টা বাজাচ্ছে।
হাতের ডানদিকে প্রথমেই চোখে পড়বে একটা খোলামেলা ঘর। ঘরের মাঝখানে দু’টো সিমেন্টের বেঞ্চ ও একটা টেবিল, চারকোণে চারটা টেবিল। কর্নার টেবিলগুলোতে বিভিন্ন ফাইলে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঙালি হত্যার কালো ইতিহাস। মূল টেবিলে মন্তব্য খাতা।
দু’জন লোককে বসে থাকতে দেখে তাদের পরিচয় জানতে চাইলাম। একজন এখানকার গার্ড, মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান আর অন্যজন মালি- আমজাদ হোসেন, যার পরম মমতায় বেড়ে উঠেছে এখানকার প্রত্যেকটি গাছ ও লতাপাতা।
জানতে চাইলাম, ‘এখানে ঘণ্টা কেন? ঘন্টা দিয়ে কি বোঝায়?’
‘ঘন্টা বাজিয়ে শহীদদের স্মরণ করা হয়, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করা হয়। প্রকাশ পায় সত্য ও ন্যায়ের বাণী, চেতনার ঘণ্টা বলতে পারেন’,গার্ড উত্তর দিলেন।
উনিই জাদুঘরটি ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। ভেতরের দেয়ালের চারপাশের বেদিতে মর্মরপাথরে খোদাই করা হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বধ্যভূমির নাম। ছয়টি কাঁচের বক্সে রাখা আছে ছয়টি বিভাগের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিগুলোর মাটি।
মাঝখানের দেয়ালে রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামানের তৈরী ভাস্কর্য ‘জীবন অবিনশ্বর’- এতে মৃত্যু ও ভীতির অমানিশা থেকে নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ব্যাপারটিকে তারা ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষ হাতে, পরম আবেগে।
ডানে সবচে শেষ কোণায় কাঁচে ঘেরা একটি ২০ ফিট প্রশস্ত স্তুপ। এটিই সেই এককালের অত্যন্ত প্রশস্ত ভয়াল মৃত্যুকূপ- পাকিস্তান আমলের ওয়াটার সেফটি ট্যাঙ্ক! মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো নয় মাসে এখানে ধরে এনে জবাই করা হয়েছে হাজার হাজার অসহায় মানুষকে।
১৫ই নভেম্বর, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর ৪৬ পদাতিক ব্রিগেড এর সহযোগিতায় এর খনন কাজ শুরু হয়। ২৩শে নভেম্বর খনন কাজ শেষ হবার পর এখান থেকে তিন ট্রাক হাঁড়গোড় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। উদ্ধার করা হয় ৭০টি মাথার খুলি ও ৫৩৯২টি অন্যান্য অস্থি। ওই হাড়গোড়গুলোর মালিকদেরকে এই জল্লাদখানায় এনে জবাই করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালে।
পাশের ঘরটির সামনে লেখা ‘জুতা খুলে প্রবেশ করুন’। ভেতরে আরও একটি কাঁচে ঢাকা কূপ, ভয়াবহ ‘ওয়াটার সেফটি ট্যাঙ্ক’টির আরেকটি অংশ। কাঁচে ঢাকা একটি শোকেসে সাজানো আছে জামা, তসবিহ, স্যান্ডেলসহ কিছু নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র। এগুলো সেইসব হতভাগ্য মানুষদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র যাদের ধরে আনা হত ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে। হয়তো গভীল রাতে ঘুমন্ত কোনো শিশুর আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল তার বাবা কিংবা মাকে, হয়তোবা তাকেও। ভারী মন নিয়ে বাইরে আঙ্গিনায় বের হয়ে আসলাম, তখনও দিনের আলো নেভেনি।
সেই স্কুলপড়–য়া ছেলেগুলিকে দেখলাম, শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে । পাশে বসলাম, ‘বললাম মন খারাপ হয়েছে?’ একজন বলল, ‘আমি ঠিকই যুদ্ধ করতাম, এত মানুষকে মরতে দিতাম না। ’
মাথা নিচু করে বসে থাকা অন্য ছেলেটি ওর কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘এখনও প্রতিদিন শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ কত মানুষকেই তো সামান্য কারণে মেরে ফেলা হচ্ছে, আমরা কিছুই করতে পারছি না। ’
বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে শেষ আলোর সাথে দিগন্তে কোথাও মিশে গেল হয়তো, ধীর পায়ে বের হয়ে এলাম। ঢং ঢং করে আবার ঘণ্টাটি বেজে উঠল। মনে হল- কেউ বুঝি চেতনার ঘণ্টাটায় আবার নাড়া দিল।
বাংলাদেশ সময় : ১৩০১ ঘণ্টা, ২৫ জানুয়ারি, ২০১২