ঢাকা: ৯/১১ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র যতোটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়। এটা এই অর্থে যে, ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা তো বটেই সাধারণ মুসলমানরাও পড়েছে নিরাপত্তা হুমকিতে।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের সমালোচনার মুখে কিছু কিছু বন্দিকে বিচারের আওতায় এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেকে এখনো বন্দি। তাদের কারো মামলা চলছে। ভাগ্যবান কেউ মুক্তি পেয়েছেন। এমনই একজন মুসলমান লাখদর বুমেদিয়েন ‘বুমেদিয়েন বনাম বুশ’ মামলার প্রধান বাদী। আমেরিকার সামরিক বন্দিশালা গুয়ান্তানামো বে’তে তিনি ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিনা বিচারে আটক ছিলেন। তারই লেখা স্মৃতিচারণের কিছু অংশ বাংলানিউজ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
গুয়ান্তানামো বে’তে আমেরিকার বিন্দশিবিরের প্রথম সাতজন বন্দির মধ্যে আমিও একজন। আর আমাকে আটক করা হয়েছিল কোনো প্রকার ব্যাখ্যা এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই। এই সময়টাতে আমার মেয়েরা বেড়ে উঠছে আমাকে ছাড়াই। তারা যখন দোলনায় তখন আমি বন্দিশালায়। এমনকি আমার সঙ্গে দেখা করা ফোনে কথা বলতেও দেওয়া হয়নি তাদের। আমি যে চিঠিগুলো লিখতাম তার বেশিরভাগই ফেরত আসত ‘অবিতরণযোগ্য’ বলে। পরিবার থেকে যে দু’একটা চিঠি আসত তাতে পুরোপুরি এবং অভাবনীয় রকমের কাটছাট করা হতো যাতে তাদের ভালবাসা ও সান্তনার কথাগুলোর রেশমাত্র থাকত না।
কিছু আমেরিকান রাজনীতিক বলেন, গুয়ান্তানামোতে বন্দিরা সব সন্ত্রাসী। কিন্তু আমি তো কখনও সন্ত্রাসী ছিলাম না! আমাকে আটক করে আদালতে নেওয়া হয় সেখান থেকে সোজা এখানে আনা হয়েছে। এটা করা না হলে, আমার সন্তানেরা কখনোই আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত না, আমার পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে নিপতিত হতো না।
বিদেশে কাজের সন্ধানে ১৯৯০ সালে আমি আলজেরিয়া ছাড়ি। ১৯৯৭ সালে আমার চাকরিদাতার নির্দেশে পরিবার নিয়ে বসনিয়া-হারজেগোভিনাতে চলে যাই। আমি কাজ করতাম সংযুক্ত আরব আমিরাতের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে। বলকান সহিংসতায় অভিভাবকহারা নিঃস্ব শিশুদের সাহায্যার্থে পরিচালিত মানবিক সাহায্য কর্মসূচির সারাজেভো কার্যালয়ের পরিচালক ছিলাম আমি। ১৯৯৮ সালে বসনিয়ার নাগরিকত্ব পাই। আমাদের একটা সুন্দর জীবন ছিল, কিন্তু ৯/১১ এর পর সব বদলে গেলো।
২০০১ সালের ১৯ অক্টোবর সকালে অফিসে গিয়ে দেখি একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন বলে আমাকে তিনি ডেকে নিলেন। আমি স্বেচ্ছায় তার সব প্রশ্নের জবাব দিলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য- এরপর আমাকে বলা হলো ‘আপনি বাসায় ফিরতে পারবেন না!’ অথচ যুক্তরাষ্ট্র তখন বলেছিল, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নাকি আমাকেসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। মিডিয়াতে খবর বেরুলো- যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় বিশ্বাস, আমি সারাজেভোতে মার্কিন দূতাবাস বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছিলাম। আমি কখনই এমন চিন্তা করিনি- এক সেকেন্ডের জন্য- এই বিষয়টি বিবেচনা করুন।
আসল ব্যাপার হলো যুক্তরাষ্ট্র যে একটা বড় ভুল করছিল তা প্রথম থেকেই স্পষ্ট ছিল। বসনিয়ার উচ্চ আদালত আমেরিকার দাবির বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করেছে। তারা আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পায়নি এবং ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাকে মুক্তি দেওয়ার মুহূর্তেই আমেরিকার চরেরা আমাকে ও অপর পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায়। আমাদের গরু-ছাগলের মতো করে বেঁধে আমেরিকার নৌঘাঁটি গুয়ান্তানামোতে উড়িয়ে নেওয়া হলো। আমরা সেখানে পৌঁছলাম ২০০২ সালের ২০ জানুয়ারি।
তখনও আমেরিকানদের সুবিচারের প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল। আমি বিশ্বাস করতাম আমার বন্দিকর্তা শিগগির তাদের ভুল বুঝতে পারবে এবং আমাকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু যখন প্রশ্নকর্তাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আমি সুযোগ পাচ্ছি না- কীভাবে আমি পারতাম- যখন আমি কোনও ভুলই করিনি? -তারা দিনকে দিন আরো নিষ্ঠুর হতে লাগলো। টানা কয়েকদিন আমাকে ঘুমাতে দেওয়া হতো না। কখনো টানা কয়েক ঘণ্টা কষ্টকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হতো। এসব বিষয় আমি লিখতে চাই না। এসব ভয়ঙ্কর স্মৃতি আমি ভুলে যেতে চাই।
আমাকে কেন বন্দি করে রাখা হচ্ছে এ প্রশ্নের যখন জবাব পাচ্ছি না তখন আমি দুই বছরের অনশনে গেলাম। এই সময় তারা দিনে দুইবার আমার নাক দিয়ে গলা হয়ে পাকস্থলি পর্যন্ত পাইপ ঢুকিয়ে খাবার প্রবেশ করাতো। এটা ছিল তীব্র যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু আমি তো কোনো দোষ করিনি। আমি নিরপরাধ তাই আমি প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম।
অবশেষে, ২০০৮ সালে আমার ব্যাপারে সুষ্ঠু আইনি পদক্ষেপের দাবি আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালতে গেল। আমার নামে একটি সিদ্ধান্ত এল। সুপ্রিমকোর্ট ঘোষণা দিলেন- যে কোনো সময় বা পরিস্থিতিতে আইন ও সংবিধান সমুন্নত থাকবে। কোর্ট রায় দেন, আমার মতো যারা বন্দি রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যতোই গুরুতর হোক না কেন, আদালতে আসার অধিকার তাদের আছে। সুপ্রিমকোর্ট একটি মৌলিক সত্য স্বীকার করলেন, সরকার ভুল করেছে। আদালত আরও বললেন, একটা ভুলের কারণে কোনো ব্যক্তি প্রতিকূল সময় কাটাতে বাধ্য হতে পারে, হতে পারে এ সময়টা একটা প্রজন্ম পর্যন্ত বা তারও বেশি দীর্ঘ। এই ঝুঁকিটা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে উপেক্ষা করা যায় না।
এর পাঁচ মাস পরে ওয়াশিংটনে কেন্দ্রীয় জেলা কোর্টের বিচারক রিচার্ড জে লিওন আমাকে বন্দি রাখার কারণসমূহ পর্যালোচনা করেন। এরমধ্যে কিছু গোপন তথ্যও ছিল যা আমি আগে কখনো শুনিনি। বিচারকের সামনে শুনানির ঠিক আগ মুহূর্তে সরকার দূতাবাসে হামলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রত্যাহার করল। আদালত শুনানির পর আমাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিলেন। বসনিয়াতে আটক অপর চারজনকেও ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল।
গুয়ান্তানামোর একটি নোংরা কক্ষে ওই চারজনের সঙ্গে বসে আমি শুনছিলাম যখন একটা ঘরঘরে স্পিকারে বিচারক লিওন ওয়াশিংটন এজলাশ থেকে রায় পড়ে শুনাচ্ছিলেন। তিনি সকাতরে বলছিলেন, সরকার যেনো তার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করে। কারণ, একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তাদের সুযোগ পেতে সঠিক আইনি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার মাঝখানে সাতটি বছর কেটে গেছে। আমার বিচারে এটা যথেষ্ট হয়েছে। –সে দিনের স্মৃতি আমি কখনো ভুলতে পারব না।
১৫ মে, ২০০৯ সাল, আমি মুক্তি পেলাম।
এখন আমি স্ত্রী সন্তান নিয়ে প্রোভেন্সে বসবাস করি। ফ্রান্স সরকার আমাদের একটি বাড়ি দিয়েছে। আবার নতুন করে জীবন শুরু করেছি। আমাদের সেই ছোট্ট মেয়ে দু’টি এখন অনেক বড় হয়েছে। তাদের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়ার সুখকর অভিজ্ঞতা হলো আমার। ২০১০ সালের আগস্টে আমি আমার শিশুপুত্র ইউসেফকে পেলাম। আমি এখন কারিগরি প্রশিক্ষণের আওতায় ড্রাইভিং শিখছি। নতুন করে জীবন গড়ছি। আমার আশা, আবার মানুষের সেবা করার সুযোগ পাব।
তবে যতোদূর সম্ভব, আমি যেহেতু গুয়ান্তানামোতে সাড়ে সাত বছর কাটিয়ে এসেছি সেহেতু খুব কম মানবাধিকার সংগঠনই আমাকে চাকরি দেওয়ার কথা ভাববে। আমি এখন আর গুয়ান্তানামো নিয়ে ভাবতে চাই না। সেই স্মৃতি শুধু বেদনার। কিন্তু আমার এই গল্প সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করছি কারণ এখনও সেখানে ১৭১ জন বন্দি মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের মধ্যে একজন বেলকাসেম বেনসায়াহ। তাকেও আমার সঙ্গে বসনিয়া থেকে আটক করা হয়।
এখন প্রায় ৯০ জন বন্দিকে গুয়ান্তানামো থেকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে আছেন সিরিয়া বা চীনের মতো দেশের- এখন যদি তাদের নিজ দেশে বা ইয়েমেনে পাঠানো হয় তাহলে তারা নির্যাতনের শিকার হতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এই দেশকে অস্থিতিশীল মনে করে। এবং তারা বন্দি থাকবে অনির্দিষ্টকাল; তারা বিপজ্জনক বা আমেরিকায় হামলা করবে এই কারণে নয়- কারণটা হলো গুয়ান্তানামোর দাগ তাদের শরীরে থাকার কারণে কেউ তাদের গ্রহণ করবে না, তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। এমনকি আমেরিকাও তাদের একজনকেও মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেবে না।
আমি বলেছি, আমার এই মামলা যেনো এখন আইন স্কুলগুলোতে পড়ানো হয়। এটাই হয়ত একসময় আমাকে অনেক শান্তি দেবে। কিন্তু যতোদিন গুয়ান্তানামো খোলা থাকবে এবং সেখানে নিরোপরাধ মানুষকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হবে, সেই দুর্ভোগ আর অবিচারের কলঙ্কিত স্থানে যারা রয়েছেন তাদের জন্য আমার ভাবনাগুলো তোলা থাকবে।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর: জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১২