কুমিল্লা: কুমিল্লার গোমতী নদীর তীরবর্তী ছায়াঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত গ্রাম পাচঁথুবী। আখের গুড় ও আধরসি তৈরির গ্রাম হিসেবে পুরো কুমিল্লাজুড়েই যার পরিচিতি।
কুমিল্লা মহানগরের চকবাজার বেবিস্ট্যান্ড থেকে রিকসা কিংবা সিএনজি ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা যোগে গোমতী ব্রিজ পার হয়ে পাচঁথুবী গ্রামে যেতে সময় লাগে ১০ মিনিট, ভাড়া ১০-১৫ টাকা।
গ্রামের পুরো বিশেষত্বই রয়েছে এখানে। শহুরে যান্ত্রিক কোলাহলের বাইরে এ গ্রামে ঢুকেই গুড় তৈরির মিষ্ঠি গন্ধ বিমোহিত করবে যে কাউকে।
স্থানীয় এলাকাবাসি জানায়, পাচথুঁবী গ্রামের প্রায় ২০টি পরিবার আখের গুড় ও আধরসি তৈরি পেশায় জড়িত। এদের মধ্যে অন্যতম পাচথুঁবী গ্রামের আব্দুল্লাহ মিয়ার ছেলে শাহজাহান (৫০) । গত ১০ বছর ধরে আখ চাষ ও আখ থেকে গুড় ও আধরসি তৈরি পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে এখন সে স্বাবলম্বী । তার দেখাদেখি গ্রামের অন্যান্য লোকরাও এ পেশায় জড়িত করছে নিজেদের ।
শাহজাহান বাংলানউজকে জানান, আমি ২০০৬ সালে নিজস্ব ৩ কানি (১.২ বিঘা) জমিতে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে ২০ হাজার চারা রোপন করেছিলাম। প্রতিটি চারাগুটি ১ টাকা করে কিনেছি। এই আখ চাষ মূলত শীতকালে করলে ভালো হয়। ফলনের প্রথম ২/৩ বছর উৎপাদিত আখের রস থেকে ১২০ থেকে ১৫০ মণ করে আখের গুড়, পরের বছরগুলো থেকে ৮০/৯০ মণ করে গুড় পাওয়া যায়। তাছাড়া আখেঁর রস থেকে প্রত্যেক বছর প্রায় ১০০ মণ আধরসি পাওয়া যায়। ফলনের প্রথম ২/৩ বছর ভালো ফলন হয়। পরবর্তী ৩/৪ বছর ফলন একটু কমে আসে। তবে আয় ভালো হয়। কারণ একবার ফলন করলেই হয়, প্রতিবছরতো আর চারা রোপন করা লাগেনা। একবছর রোপন করলে ৬/৭ বছর ফসল পাওয়া যায়।
চাষ পদ্ধতি:
১১৫৮ জাতের আখের রস থেকে পাঁচথুবি গ্রামে গুড় ও আধরসি তৈরি করা হয়। জিহ্বাতে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে, এই কারণে এ জাতের আখের রস খাওয়া যায়না। এটি চাষ করা হয়ে থাকে কেবল গুড় ও আধরসি তৈরি করার জন্য।
এ জাতের আখ চাষ করলে টানা ৬/৭ বছর ধরে ফসল পাওয়া যায়। আখচাষিরা জানান, প্রথম বছর ফসল কাটার পর পুরো জমিতে আগুন লাগিয়ে আর্বজনাগুলো পুড়ে ফেলা হয়। তারপর পুরো জমিতে গোবর, পটাশ, ফসফেট ছিটিয়ে দিয়ে আঁখ কাটার পর অবশিষ্ট যে গোড়া অর্থাৎ মূল থাকে সেখান থেকে এক থেকে দেড় সপ্তাহের মধ্যে চাঁরা গজাবে। তারপর চারার গোড়াগুলো পরিষ্কার করে সেখানে মাটি দিতে হবে। তারপর এক বছরের মধ্যে ফসল কাটার উপযুক্ত হয়। এভাবে ৬/৭ বছর ফসল পাওয়া যায়।
তৈরি হয় যেভাবে :
পরিণত আখ কাটার পর তা কেটে টুকরা টুকরা করে পুলিতে (চাকাঁ) ঢুকিয়ে রস বের করা হয়। তারপর আখের রস কাসার ট্রেতে করে সাড়ে ৩ ঘন্টা থেকে ৪ ঘন্টা পর্যন্ত আগুনের বড় চুলাতে জাল দেয়া হয়। চুলা থেকে নামিয়ে ১০ মিনিট রাখার পর শক্ত হয়ে যায়, তখন মাটির পাতিলে রাখা হয়। এভাবে তৈরি করা গুড় ।
আর আখের রস কাসার ট্রেতে বা কড়াইতে করে আগুনের বড় চুলাতে জাল (গরম) দেয়ার ১/২ ঘন্টা পরে বাদামি রংয়ের এক ধরণের ফেনা বের হয়, একেই নোনা বলে । এ ফেনা তখন ট্রে থেকে সংগ্রহ করে পাতিলে রাখা হয়। এটা খেতে দারুণ সুস্বাদু।
আধরসিও তৈরি করা হয় প্রায় একই নিয়মে। আখেঁর রস কাসার ট্রেতে করে ২ ঘন্টা আগুনের বড় চুলাতে জাল (গরম) দিয়ে গাঢ় হওয়ার আগেই তরল অবস্থায় পাতিলে ঢেলে রাখা হয়। এটার নামই আধরসি। আর আগুন জ্বালানোর কাজে কোন লাড়কি ব্যবহার করা হয়না। আখেঁর বাকল রৌদ্রে শুকিয়ে আগুন জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হয়।
গুড় ও আধরসি তৈরির কারিগর:
প্রত্যেক বছর শীতের সময় যখন আখের ফসল কাটার সময় হয়, তখন নাটোর থেকে শ্রমিক(কারিগর) আনা হয় পাঁচথুবিতে। যারা ফসল কাটা থেকে শুরু করে আখের গুড়, আধরসি ও নোনা তৈরি করা পর্যন্ত প্রায় ১ মাস কুমিল্লায় থাকে। পাচঁথুবী গ্রামের আখের ক্ষেতে কথা হয় নাটোরের শ্রমিকদের সাথে। নাটোরের বাগাতিপাড়া থানার গৌরিপুর গ্রামের কারিগর মোঃ জাকারিয়া হোসেন (৩২) বাংলানউজকে জানালেন, ফসল কাটা থেকে শুরু করে গুড় ও আধরসি তৈরি পর্যন্ত প্রায় ২০/২৫ দিন এখানে থাকতে হয়। প্রতিদিন পারিশ্রমিক হিসেবে ২৫০- ৩০০ টাকা করে পান তারা। প্রতি বছরের মতো এবারও এসেছেন এখানে।
বিপণন:
কুমিল্লার বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা এই এলাকা থেকে এসে পাইকারি দরে গুড় ও আধরসি ক্রয় করে নিয়ে যায়। পাচঁথুবী গ্রামের গুড় ও আধরসি তৈরি কারখানার মালিক শাহজাহান বাংলানউজকে বলেন, ১ কেজি গুড় ৮০ টাকা, ১ কেজি আধরসি ৮০ টাকা এবং নোনা ৩০০ কেজি পাইকারি দরে আমরা বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করি। এখানকার তৈরি গুড় ও আধরসি কুমিল্লা মহানগরের চকবাজার, রাজগঞ্জ,বাদশাহমিয়ার বাজার, রাণীরবাজার, বুড়িচংয়ের শিবেরবাজার, সদরের সুর্বণপুর বাজারে বিক্রি হয়। পাচথুঁবী গ্রামের বাসিন্দা শাহ ইমরান বলেন, এ গ্রামটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানকার গুড় ও আধরসি ভারতেও চোরাইপথে নিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ শীতকালে এ গ্রামে আসে গুড় ও আধরসি কিনে নেওয়ার জন্য।
এলাকাবাসিরা জানান, এখানকার চাষীরা ৩/৪ কানিতে আখ চাষ করে। এতে খরচ হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। প্রতিবছর প্রায় এ আখের রস থেকে সর্বনিন্ম ২০০ মণ গুড় ও আধরসি তৈরি হয়। এগুলো পাইকারি দরে বিক্রি করে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা পাওয়া যায়। শ্রমিক ও যন্ত্রপাতিতে খরচ হয় সবোর্চ্চ ৪০ হাজার টাকা। ফলে প্রতিবছরে লাভ হয় সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা। আর এই আখঁ একবার চাষ করলে টানা ৬/৭ বছর ফসল পাওয়া যায়।
ফলে একবার রোপনে এই ফসল থেকে ৭ বছরে আয় হয় সর্বনিম্ন ৩৫ লক্ষ টাকা। যাদের নিজস্ব জমি আছে এমন সবাই ঝুকঁছেন আখ চাষে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১২