উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ফিরে: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করা বাংলাদেশের বহুমাত্রিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এসব ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সবচে’ বেশি ব্যাহত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে বিস্তীর্ণ এলাকায় স্বাভাবিক চাষাবাদ সম্ভব হচ্ছে না। দেশের ক্রমবর্ধমান বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এটি বড় ধরণের হুমকি। একে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে এরই মধ্যে সংকট মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে দেশের কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে বিস্তর গবেষণাও শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো মূলতঃ এসব কাজ করছে। তবে চলমান এসব গবেষণা ও অন্যান্য তৎপরতা বর্তমান এবং ভবিষ্যত সংকট লাঘবে

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্রের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ফলে অতি বৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, তীব্র খরা, নদীর নাব্যতা সংকট, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের কারণেও অনেক জমিতে ফসল ফলানো দুরূহ হয়ে পড়েছে।
প্রাথমিক ক্ষতির শিকার অঞ্চলগুলো
সরকারি ও বেসরকারিভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাথমিকভাবে ক্ষতির শিকার অঞ্চলগুলো চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রাজশাহী প্রভৃতি উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোকে অধিক খরাপ্রবণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, জামালপুর, মাদারিপুর প্রভৃতি জেলাকে বিবেচনা করা হচ্ছে। আগাম বন্যাপ্রবণ হিসেবে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রোকোনা, শেরপুর প্রভৃতি জেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাছাড়া অধিক লবনাক্ত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে খুলনা, পিরোজপুর, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলাকে। চিহ্নিত এসব এলাকার কৃষি আবাদ অসম্ভব চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ছাড়াও বাংলাদেশের কৃষি বিপর্যয়ের জন্য অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন, নগরায়ন এবং শিল্পায়নও অনেকটা দায়ী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব মানবসৃষ্ট কারণে প্রতিদিন গড়ে ২২০ একর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এভাবে গত ২০ বছরে কৃষি জমি কমেছে ৫০ লাখ একর। এতসব বিপর্যয় সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমস্যাভিত্তিক কৃষি গবেষণা চলছে।
চলছে গবেষণা
বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট (বিএআরআই), ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (ব্রি), আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (ইরি), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট (বিনা) ও বিশেষায়িত বেশ কয়েকটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাধিক এনজিও পরিবর্তিত জলবায়ুর ঘাত মোকাবেলায় কৃষি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে গবেষণা জোরদার করেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব কবলিত এলাকায় ফার্ম স্থাপন করে প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী জাত সম্প্রসারণের জন্য পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালিত করছে।
লবণ সহিষ্ণু জাত আলো দেখাচ্ছে, তবে সমস্যাও আছে
জমির মাত্রাতিরিক্ত লবলাক্ততা প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলার লবনাক্তপ্রবণ কালিগঞ্জ উপজেলার ভাড়াসিমলা গ্রামের আইপিএম ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কৃষক জাকির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বর্ষা না এলে লবণ অনেক বেড়ে যায়। লবণের জন্য আগে ওই এলাকার জমিতে কোনো ফসল ফলতো না। লবণসহিষ্ণু জাত পাওয়ার পর সেসব এলাকায় নতুন করে চাষাবাদ শুরু হয়। বর্তমানে ওই এলাকাতে ভুট্টা, গম ও আমন ধান ভাল হচ্ছে।
প্রান্তিক কৃষকদের অভিযোগ যেন অরণ্যে রোদন

তবে ব্রি-৪৭ নামের লবন সহিষ্ণু জাত চাষ করে সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে জানালেন কৃষক জাকির। তিনি জানান, পাকার পর সামান্য ঝড়েই সব ধান পড়ে যায়। তাছাড়া লবণাক্ত উপকূলীয় এলাকাতে কৃষি আবাদের জন্য বড় সমস্যা অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের। প্রভাবশালীরা জোর করে কৃষি জমিতে চিংড়ী ঘের বানাচ্ছে। সেসব ঘেরে কৃত্রিম কায়দায় লবণ পানি ঢুকাচ্ছে। এর ফলে ধীরে ধীরে আবাদি জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় মূলতঃ অসহায় হতদরিদ্র প্রান্তিক কৃষকরা ক্ষতির শিকার হন। আর তাই প্রশাসনও তাদের কোনো অভিযোগ আমলে নেয় না বলে অভিযোগ করলেন জাকির হোসেন।
লবণাক্ততা সমস্যাকবলিত এলাকায় কাজ করা বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউটের বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বতর্মানে লবণাক্ততা দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থার জন্য বড় ধরণের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে লবণসহিষ্ণু জাত সম্প্রসারণের পূর্বে দেশে লবণাক্ততার কারণে পতিত জমির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টরে। পরবর্তীতে গবেষণায় উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু জাত কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে এসব পতিত জমির শতকরা ২০-৩০ ভাগ বর্তমানে আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে বিনা উদ্ভাবিত বোরো মৌসুমে আবাদের জন্য ক্ষারত্ব সহ্যক্ষমতা সম্পন্ন বিনা ধান-৮ কৃষি বিভাগের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হয়েছে।
ড. মির্জা জানান, আগামী বেরো মৌসুমের মধ্যে ক্ষারত্ব সহিষ্ণুজাত ধান লবণাক্ত এলাকাতে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
তিনি আরো জানালেন, লবনাক্ততার পরিমাণ যে হারে বাড়ছে তাতে আমাদের পর্যায়ের গবেষণা যথেষ্ট নয়। লবণাক্তপ্রবণ ভূমির ৮০-৯০ ভাগ আবাদের আওতায় আনা গেলে সংকট কমবে। তাই সার্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে এসংক্রান্ত গবেষণায় দক্ষ জনবল বৃদ্ধি ও পর্যাপ্ত আর্থিক পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন। একইসাথে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, বিএডিসি, বিভিন্ন এনজিও ও সার্বিকভাবে কৃষকদের এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন করতে হবে। লবণ মাপার যন্ত্র সরবরাহ করতে হকে কৃষক পর্যায়ে। কারণ মাটির ক্ষারত্ব না জেনেই অনেক কৃষক চাষাবাদ করে ক্ষতিগ্রস্থ হন। এছাড়া লবনাক্ততা মোকাবেলায় কৃষি ব্যবস্থাপনার দিকে জোর দিতে হবে।
বিএআরআই’র গবেষণা
দেশের কৃষি গবেষণার বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট (বিএআরআই) জলবায়ু পরিবর্তন বা লবনাক্ততা সমস্যা মোকাবেলায় বেশ কিছু ফসলের সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে। উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও বরিশালে বিএআরআই’র আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্রসমূহে লবণসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
অধিক লবণাক্তপ্রবণ জেলা সাতক্ষীরার বিনেরপোতা কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান ড. একেএম হাবিবুর রহমান লবণাক্তপ্রবণ ভূমিতে কৃষি আবাদ উপযোগী জাত উদ্ভাবনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলানিউজকে জানান, ‘লবনাক্ত উপকূলীয় বিশাল পতিত ভূমিকে কৃষি আবাদের আওতায় আনতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট বর্তমানে প্রায় ৩৭ প্রকার ফসল নিয়ে গবেষণা করছে। এরমধ্যে উদ্ভাবিত কয়েকটি লবনসহিষ্ণু ফসলের জাত কৃষক পর্যায়ে অবমুক্ত করা হয়েছে। এসবের মধ্যে লবণসহিষ্ণু গম, মুগ ডাল, মিষ্টি কুমড়া, সরিষার জাত সফলভাবে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে। অবমুক্ত করা বারি গম (১০-১৫ পার ডিএস মিটার) ও বারি মুগ ডাল (১১-১৩ পার ডিএস মিটার পর্যন্ত) লবণসহিষ্ণুতা রাখে। তবে উপকূলীয় এলাকাতে গড় লবণাক্ততা এখন ১৫-২০ পার ডিসএস মিটার পর্যন্ত পৌঁছেছে।
ড. হাবিব আরো বলেন, ‘প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী জাত বের করতে অনেক সময় লাগে। তাই আমরা শুধু জাত উদ্ভাবনে বসে নেই। বর্তমানে লবণাক্ত ভূমিতে কৃষি আবাদ করতে সয়েল ম্যানেজমেন্টের দিকে আমরা জোর দিচ্ছি। ’

দেশের প্রধানতম খাদ্য শস্য ধান। এখনো ধানের উৎপাদনের ওপর বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা সিংহভাগ নির্ভর করে। লবণাক্ততা সমস্যার কারণে উপকূলীয় এলাকার ধান উৎপাদন দারুনভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ সমস্যা লাঘবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট অনেক আগে থেকেই গবেষণা শুরু করে ঘাত সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে। এরই মধ্যে সাফল্য এসেছে অনেক। উপকূলীয় লবনাক্ত জমিতে চাষ করা ধানের বেশির ভাগই ব্রি’র উদ্ভাবিত। এসব জাতের মধ্যে ব্রি ধান-৪৭, ব্রি ধান-৪০, ব্রি ধান-৪১, ব্রি ধান-৫৩ ও ব্রি ধান-৫৪ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউটের (ব্রি) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকতা ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউটের (ইরি) পোস্ট ডক্টরেট ফেলো ড. রফিকুল ইসলাম জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্রি’র বর্তমান ও ভবিষ্যত গবেষণা সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, ‘১৯৯৮ সাল থেকে আমি লবনাক্ততা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে কাজ করে আসছি। এপর্যন্ত ব্রি ৫টি লবণ সহিষ্ণু ধানের জাত অবমুক্ত করেছে। আরো অধিক ক্ষারত্ব সহনশীল (১৪ পার ডিএস মিটার) সক্ষমতার একটি জাতের ইভালুয়েশন ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত এটি মাঠ পর্যায়ে অবমুক্ত করা সম্ভব হবে। লবনাক্ততা ছাড়াও জলাবদ্ধতা ও অধিক খরা খাদ্য উৎপাদনের বড় বাধা। ব্রি এসব সংকট লাঘবেও সুদূর প্রসারি গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. তোফাজ্জল ইসলাম জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে গতানুগতিক কৃষি গবেষণায় না যেয়ে সমস্যাভিত্তিক কৃষি গবেষণার পক্ষে মত দেন। তিনি মনে করেন,

এছাড়া জলবায়ু বিপন্নতার বিষয়টি উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করাও জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৮ ঘণ্টা, ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২