ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

এক হংস-বালক হেলালের কথা

ইকবাল জাফর খন্দকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:০৬, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১২
এক হংস-বালক হেলালের কথা

সারল্যে ভরা শিশুর স্মিত হাসিতে পরিবেশটা আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। হাসি-মুখেই বলল, ‘বলেন কার কী লাগবে?’

চা, পুরি, সমুচা, পাকুরা অথবা চপ, জুস, মাশরুম... যে যার মতো অর্ডার দিলাম।

অর্ডার নিয়ে হাসিমুখেই সে ছুটল বাবুর চায়ের দোকানে। আমরা নিমতলা অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের মেঝেতে গল্পে মেতে উঠলাম ফের।

স্বল্প সময়েই হেলাল নোমের শিশুটি প্লেটভরে ভাজাভুজি নিয়ে হাজির। মুখে সেই মৃদু-হাসি। আমাদের অর্ডারের চা-পানি-নাস্তা দেওয়া তখনো শেষ হয়নি। আশ-পাশ থেকে ডাক শুরু- হেলাল, এই হেলাল... এদিকে, এদিকে আস...
সে ঘুরে ঘুরে সবাইকে আশ্বস্ত করতে থাকে, আসছি, আসছি মামা...

একজনের বা এক আসরের ক’জনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কি তার চলবে? সন্ধ্যায় খণ্ড-খণ্ড জমে ওঠা আড্ডায় সে’ই তো ‘মোস্ট ওয়ান্টেড পারসন। ’ কিন্তু এত ব্যস্ততা, এত তাড়া, এত ‘অর্ডার বাই সাপ্লাইয়ের’ বোঝা, বকা-ঝকার মাঝেও তার কচি মুখটি কখনোই ম্লান হয়ে ওঠে না। হাসিমুখে মৃদৃমন্দ উচ্চস্বরে পষ্ট করে কথা বলাই তার চির-চেনা রূপ। অবশ্য তার সঙ্গে ওই টি-স্টলে আরও ক’জন শিশু আছে। কিন্তু ঘুরে ফিরে প্রথমেই সবাই হেলালকেই খুঁজে।

কিছুদিন আগেও সে মাথায় ব্যান্ডেস নিয়ে কাজ করেছে। এর আগে তার হাত কেটে গিয়েছিল। কিন্তু এইসব দুর্ঘটনা, ব্যস্ততা, অতীতের দুঃখ আর খদ্দেরের বকাঝকায় তার মুখ কখনো কালো হয়ে ওঠেনি। সর্বদা তার হাসি-মুখ। একেই বলে বুঝি ‘হংস-স্বভাব’! শত পঙ্কিল-কাদার মাঝে ডুব দেবার পরও ডাঙ্গায় এসে এক ঝাড়া দিয়েই পঙ্কিলতা আর পাঁক-কাদামুক্ত হবার সহজাত যোগ্যতা যোগ্যতা। শত কাজের তাড়া, খদ্দেরদের চিৎকার, বকা-ঝকা, শত দুঃখকে হংসের মত এক ঝিলিক হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেবার বিস্ময়কর যোগ্যতা দেখে মাঝেমধ্যেই হিংসে হয়- হেলাল নামক হংস-বালকটির অর্জন দেখে। মনে পড়ে যায় একটি উর্দু শেরের- ‘হার মুশকিলকো দিয়া হ্যায় ইক তাবাস্সুমসে জওয়াব/ ইসি তারহা গার্দিশে দৌরোকো রুলায়া হ্যায় ম্যায়নে!’

অর্থাৎ- জীবন চলার পথে নানা ধরনের বিপদাপদ আর কষ্ট ক্রুর ভ্রূকুটি হেনে আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছে, হতাশার ‍কালো কাফনে নিমজ্জিত করতে চেয়েছে। কিন্তু প্রতিটি সংকট আর বিপদকেই আমি মুচকি হাসি দিয়ে মোকাবেলা করেছি। এর ফলে আমাকে বিপদে ফেলতে আসা বিপদ নিজেই হতাশ হয়ে বিদায় হয়েছে ব্যর্থতার ক্রন্দনকে সাথী করে।
হেলালের প্রত্যাশা, এই হংস স্বভাবটি ধরে রেখে নিত্যদিনকার কষ্ট, পরিবেশ থেকে পাওয়া শিক্ষা আর সংগ্রামের মাঝে একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবার পথটি খুঁজে নেওয়া।

হেলাল প্রকৃতির ছাত্র, সমৃদ্ধ সামাজিক আবহের ছাত্র। কর্মনিষ্ঠ ছেলেটির যেন কোনো ক্লান্তি নেই। নেই কারো প্রতি কোনো অভিযোগ, অনুযোগ। কাজেই তার আনন্দ, কাজেই তার তৃপ্তি। তার নিঃশব্দ হাসি, চাল-চলন, কথা বলার ভঙ্গি ও ধৈর্য্য দেখে আঁচ করার উপায় নেই যে সে অক্ষরজ্ঞান লাভেরও সুযোগ পায়নি। আসলে পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রকৃতিই তার শিক্ষক এবং সে তার একনিষ্ঠ ছাত্র। যে কিনা রাং ফেলে সোনাকে বেছে নিতে জানে। তরুণ লেখকদের সঙ্গে এক আলোচনায় ড. গোলাম মুরশিদ বলেছিলেন, ঠাকুরবাড়ির বিড়ালটাও যে দু’টো কবিতা লেখার যোগ্যতা রাখত। শিল্প-সাহিত্যের নানা দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বসূরীদের পারিবারিক সমৃদ্ধি ও চর্চার দিকে ইঙ্গিত দিতেই ডক্টর মুরশিদের ‘বিড়াল’ রূপকটির ব্যবহার। আর হেলাল? দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান-প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের কলরবে মুখরিত গ্রন্থাগার চত্বরের আবহই বুঝি হেলালকে স্বশিক্ষিত করে তুলছে- তার অসাধারণ সৌজন্যমাখা আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সম্পন্ন আচণের ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে একথাই মনে হয় আমার। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই একজনের হাতে অপরজন লাশে পরিণত হন- তখন অনেকটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি নিজের ব্যাখা নিয়ে।

সে যাকগে, বলছিলাম শিশু হেলালের কথা। তার কথায়ই আবার ফিরে যাই। চাঁদপুর জেলার মতলবের নারাণপুরে জন্ম। মা রয়মন বেগম যখন ক্যান্সারে মারা যান তখন হেলাল খুবই ছোট। হেলালের গেরস্থ বাবা আমীর হোসেন ফের বিয়ে করেন। এরপর শিশুর নিরাপত্তার কথা ভেবে স্নেহময়ী খালা শিশু হেলালকে কচুয়াতে নিজের কাছে নিয়ে যান। হেলালরা দুই ভাই। রাজমিস্ত্রী বড়ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। এছাড়া বর্তমান মায়ের ঘরে হেলালের ছোট-ছোট আরও ৩ ভাই রয়েছে।

বছর দুই হল হেলাল বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের নিকটবর্তী একটি টি-স্টলে কাজ করছে। সে জানাল, তার বয়স ৯ অথবা ১০ বছর। তাদের স্টলের মালিক আবুল হোসেন ভাল মানুষ। তিনি তাকে খুবই স্নেহ করেন। আর আবুল হোসেন অর্থাৎ আবুল মামার স্ত্রী’ই এখন হেলালের মামী তথা মা।

হেলালের ভাষায়- ‘মামী আমারে মায়ের অভাবডা ভুলাইয়া রাখেন। তিনি আমারে খুবই আদর-যতœ দেন। হেই তিনিই আমার মায়ের উপরে। তিনিই তো আমার মা...’

সে আরও জানাল অসুখে-বিসুখে তার মামীর মায়ের মত স্নেহ-মমতা ও মাহাত্ম্যের কথা। স্টলটির পরিচালক বেলাল হোসেনসহ সকলেই তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন।

হেলাল থাকা খাওয়া বাদেও মাসে ২ হাজার টাকা বেতন পায়। এছাড়া প্রতিদিন হাত খরচা পায় ১০ টাকা। ঈদ-উৎসবে

জামা-জুতা কেনার টাকাটাও স্টলের মালিক দেন। মাসে ১ হাজার তার বাবার জন্য পাঠায়। আর বাকি ১ হাজার আবুল মামার কাছে জমা রাখে। হেলাল আরও জানাল, ওই টাকা দেওয়ার ফলে তার বাবা ও বর্তমান মা তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন।

তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ভালভাবে কাজ শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। তার আরেকটি ইচ্ছা- নিজরে মায়ের নামে একটা বড় কিছু করা।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে না পারায় খুব বেশি আফসোস নেই হেলালের। পড়ালেখা নিয়ে প্রশ্ন করতেই জানালো- শিখবার পারলে ভাল হত। কিন্ত খাওয়া-পড়া লাগবে না? কাজ না করলে টাকা-টা পাব কই?

বাংলাদশে সময়: ১০৫৭ ঘণ্টা, ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।