কুমিল্লাঃ শুধু বাংলাভাষার জন্য প্রতিবাদী কণ্ঠই নয়- দেশের জন্যও জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। চলছে ভাষার মাস।
বর্তমানে চরম অবহেলায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি। পচা পানি, ময়লা-আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছে বাড়িটি। খসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তেরা।
কক্ষের বাইরেও ময়লা-আর্বজনার স্তুপ। অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত গুণী এই রাজনীতিক কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মসাগর দীঘির পশ্চিমপাড়ে বসবাসের জন্য একখন্ড জমি কিনে টিনের আটচালা ঘর নির্মাণ করেন। এই বাড়িতেই আমৃত্যু কাটিয়েছেন তিনি। ছয় কক্ষ বিশিষ্ট এই বাড়ির চারটি কক্ষই এখন ভগ্নস্তুপে পরিণত।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের শোবার খাটটি এখনো রয়েছে। রয়েছে তার ব্যবহৃত বালিশ। রয়েছে খাবার প্লেট, পানির গ্লাস, গায়ের কাঁথা। নিদারুণ অবহেলায় এসব স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। সংরক্ষণ করা না হলেও অচিরেই এগুলোও হয়তো এক সময় হারিয়ে যাবে।
মাতৃভাষা ও প্রিয় দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গকারী এই বীর শহীদের স্মৃতিচিহ্নের এমন অবহেলায় ব্যথিত অনেকেই।
স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, ``` খুব খারাপ লাগছে- যিনি বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাবকারী। দেশের জন্য যিনি পাক হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ দিলেন- সেই ভাষা সৈনিকের স্মৃতিটি আজ অবহেলায় বিলীন হওয়ার পথে। ``
তাঁর স্মৃতিচিহ্ন বিলীন হওয়া মানে তাঁকে অবজ্ঞা করা। তাই যত দ্রুতসম্ভব ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের বিষয়ে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোঃ রেজাউল আহসান বাংলানিউজকে জানান, ``এ বিষয়ে আমরা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তাদের সঙ্গে কথা বলছি। তার নাতনি ও তার পরিবার কুমিল্লায় আসবেন। তারপর তাদের অনুমতি নিয়ে এই বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে। ``
জীবন ও কর্ম: ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জগৎবন্ধু দত্ত পেশায় আইনজীবী ছিলেন। প্রথমে নবীনগর হাই স্কুল, পরে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন ধীরেন্দ্রনাথ।
১৯০৫ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯০৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। তিনি ১৯১০ সালে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কুমিল্লা বাংগরা হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
১৯১১ সালে কুমিল্লা জেলা বারে যোগদান করেন তিনি। কুমিল্লা আদালতের উত্তরে কাপ্তানবাজারে গোমতীর পাড়ে একটি ভাড়া বাসায় থেকে রাজনীতির সঙ্গে আইন ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে চলছিল গণপরিষদের অধিবেশন। ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন।
ওই অধিবেশনে তিনি বলেন, গণপরিষদে যে কার্যবিবরণী লেখা হয় তা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়। সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৬ শতাংশ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাই ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দিতে হবে। এতে ক্ষিপ্ত হন তখনকার পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান।
১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গভীর রাতে পাক হানাদার বাহিনী ধর্মসাগরের বাড়ি থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও পুত্র দিলীপ কুমার দত্তকে ধরে নিয়ে যায় কুমিল্লা সেনানিবাসে। সেখানেই অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় তাদের। দেশ স্বাধীন হবার পর বহু বহু খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান মেলেনি তাদের লাশ।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথা, ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন মানুষের অধিকার আদায়ে। পাকিস্তান গণপরিষদ ও পরবর্তীকালে আইন সভার সদস্য হন তিনি। পাকিস্তান গণপরিষদের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রীও হন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১২