ঢাকা: তারা ছিল একে অপরের চরম শত্রু, যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরের মূখোমুখি- বসনিয়া যুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় অধ্যায়ের সময়কার চিত্র এটি। কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস! সাবেক শত্রুদের ত্রাতা হয়ে এসেছে এখন দ্বিতীয় পক্ষ।
২০১০ সালে বসনিয়া সরকার সেনাবাহিনীকে নবীন রক্তে সাজানোর জন্য অবসরে পাঠিয়ে দিলো পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব সব সেনাকে।
কিন্তু বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এই সেনাদের প্রতিশ্রুত অবসর ভাতার চেকটি পাঠাতে ব্যর্থ হলো সরকার। ফলে অনেক সাবেক যোদ্ধার জীবনেই নেমে এলো দুঃখ-দুর্দশা।
স্লাভকো রাজেভিক এই হতভাগাদেরই একজন। গৃহযুদ্ধে সার্বদের পক্ষে লড়াই করা এই সেনার দুদর্শা এমনই পর্যায়ে নেমে গেল যে, বাড়ির বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতেও অসমর্থ হলেন তিনি। প্রতিবেশীর সংযোগ থেকে বিদ্যুৎ ধার নিতে বাধ্য হলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিন বাচ্চার স্কুলে যাওয়া আসার গাড়ি ভাড়া দেওয়াও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল।
এ অবস্থায় অনন্যোপায় হয়ে যখন তার ১৭ বছর বয়সী বড় মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করার কথা ভাবছেন, ঠিক তখনই তার ঘরে এলো অনাহুত এক নতুন অতিথি। এই দৈন্যতার মধ্যে আবার পরিবারের সদস্য বাড়ল।
অবসরে যাওয়া সেনাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান বসনীয় মুসলিম আর ক্রোয়াট সেনারা। সরকারের তরফে নগদ প্রাপ্তির কিছু বিশেষ সুবিধা পেয়েছিল তারা। অবশেষে এরাই এগিয়ে এলো তাদের দূর্ভাগা সার্ব প্রতিদ্বন্দ্বীদের সহায়তায়।
এই সুবিধাভোগী সেনারা প্রত্যেকে তাদের ভাতা থেকে ৫ ইউরো দান করলো সার্ব প্রাক্তন যোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য গঠিত তহবিলে। দেখতে দেখতে জমা পড়ল প্রায় ৫ হাজার ইউরো। ইউরোপের বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বলকানের এই দারিদ্র্য পীড়িত অঞ্চলে এই মুহূর্তে এটাই অনেক।
সার্ব যোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিলো দুর্দশাগ্রস্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোচণীয় অবস্থায় নিপতিতরা পাবে সবচে বেশি অর্থের ভাগ।
প্রথম মাসের জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়তার জন্য মনোনীত হলো রাজেভিক। তিনি এবং তার মতোই আরেক দুর্দশাগ্রস্ত পাবে ৫০০ ইউরো, বাকি অর্থ থেকে ৬০ ইউরো করে ভাগ হবে অপর ৫৫ দূর্ভাগার মধ্যে।
এটা হলো সেই দৃষ্টান্তের মধ্যে একটি, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে নৃশংস আর রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে লিপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বীরা একে অপরের বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
গণকবরে শায়িত লাশের স্তুপ, মুহূর্মুহ গুলি বোমা, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড; পরিণতি এক লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি। বিভীষিকাময় যে যুদ্ধ বলকানসহ পুরো ইউরোপকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সেই গৃহযুদ্ধের চরম শত্রু সার্ব যোদ্ধাদের বর্তমান দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে প্রথমেই এগিয়ে এলো যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রোয়াট আর বসনীয় যোদ্ধারা।
নিজেদের স্বল্প পরিমাণ পেনশনের অর্থ থেকেই কিছু অংশ দিয়ে সাহায্য করলো তারা সার্ব যোদ্ধাদের। সাবেক সার্ব যোদ্ধা রাজেভিক বসনীয় সার্ব সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ২০ বছর আগে বসনীয় আর ক্রোয়াটদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে এক লাখ মানুষ প্রাণ হারায় আর ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। রাজেভিক নিজেও এর শিকার। ঘর বাড়ি হারিয়ে তিনি পরিণত হন শরণার্থীতে।
অবশেষে ১৯৯৫ সালে ডেটন শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বলকানের যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে শান্তি এলো। এক সময়ের বহু নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত দেশ পরিণত হলো মোটা দাগে পৃথক দুই জাতি অধ্যুষিত দুটি আলাদা রাষ্ট্র; সার্ব প্রজাতন্ত্র আর বসনীয়-ক্রোট ফেডারেশন।
এর পর কেটে গেছে এক দশক। অতীতের তিক্ততা ভুলতে পরে এই তিন জাতি বাহিনীকে এক করে গড়ে তোলা হয় একটি অভিন্ন সামরিক বাহিনী।
একজন পেশাদার সৈনিক হিসেবে রাজেভিক নিজেকে আবিষ্কার করেন সেনা ব্যারাকে তার এক সময়ের প্রবল শত্রুদের মাঝখানে। প্রবল শত্রু পরিণত হলো সহকর্মীতে।
২০১০’এ পার্লামেন্টে ৩৫ বছরের বেশি বয়সী সেনাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আইন পাস হলো। রাজনীতিকরা এই যোদ্ধাদের অবসরে পাঠালেও তাদের কোনো পেনশন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলো। এর মধ্যেই অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনে ছয়টি দল জিতলেও মন্ত্রণালয় ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে শেষ পর্যন্ত সরকার গঠন হলো না। সেই থেকে এখনও দেশটি চলছে কোনো নির্বাচিত সরকার ছাড়াই।
দেশে কোনো সরকার নেই তাই বাজেট পাসেরও নাম নেই। এ কারণে সাবেক সেনাদের জন্য কোনো পেনশন বরাদ্দের কথাও কেউ ভাবে না।
তবে বসনীয়-ক্রোয়াট অঞ্চলের সেনাদের বিক্ষোভের মুখে কর্তৃপক্ষ সম্মত হলো প্রতিমাসে প্রত্যেককে ১৬০ ইউরো ভাতা দিতে। কিন্তু সার্ব কর্তৃপক্ষ তাদের সেনাদের এই সুবিধা দিতে অস্বীকার করলো।
বসনীয় এবং ক্রোয়াট সেনারা গত জানুয়ারিতে পেনশনের প্রথম কিস্তির টাকা পেলো যথাসময়েই। কিন্তু তারা ভুলে গেলো না এখন দুর্দশাগ্রস্ত সে সময়ের যুদ্ধক্ষেত্রের শত্রুদের কথা। প্রত্যেকেই তার নিজের অংশ থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ জমা দিলো সার্ব সেনাদের সহায়তার জন্য গঠিত তহবিলে।
‘আমি প্রথমে হতবাক হয়ে যাই’ এভাবেই অনুভূতি ব্যক্ত করলেন সাবেক সার্ব যোদ্ধা জেলেতোভিক। তহবিলের টাকা বণ্টনের ভার পড়ে তার ওপর।
‘আমরা একে অপরকে মারার জন্য এক সময় গুলি করেছি। কিন্তু এখন আমাদের এই দুঃসময়ে সহায়তার জন্য আসছে তাদেরই তরফে, এ অবিশ্বাস্য!’
দুই অংশকে বিচ্ছিন্ন করতে নির্মিত দেয়ালের অপর পাশে বসনিয়া নিয়ন্ত্রিত শহর গোরাজদে’র বাসিন্দা সাবেক বসনীয় যোদ্ধা সেনাদ হুবিজার সাবেক যোদ্ধাদের প্রতি রাজনীতিকদের আচরণে হতাশা ব্যক্ত করলেন।
‘আমাদের বয়স যখন ১৬ তখন রাজনীতিকরা হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে বাধ্য করলো একে অপরকে হত্যা করতে। আর এখন তাদের নির্বুদ্ধিতা আবার সাবেক যোদ্ধাদের বাধ্য করছে একে অপরের কাছাকাছি আসতে। ’
যুদ্ধের সময় হুবিজার কল্পনাও করতে পারতো না কখনও প্রতিবেশী সার্ব অধ্যুষিত শহর রজাতিকায় যাওয়ার কথা। অথচ এখন তিনি সাবেক সার্ব যোদ্ধাদের সঙ্গে একত্রে সেই শহরের মধ্যে দিয়ে রাজধানী সারাজেভোতে যান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিতে।
সাবেক বসনীয় যোদ্ধা নিহাদ গ্রাবোভিকা এই ঐতিহাসিক পরিহাস দেখে শুধু মুচকি হেসে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলো এভাবে, ‘যারা এক সময় আমাদের গুলি করতো মেরে ফেলার জন্য এখন আমরাই তাদের সহায়তা করছি যাতে তারা তাদের শিশুদের খাওয়াতে পরাতে পারে। ,
এইই হলো একটি যুদ্ধের পরিণতি। রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধ বাধিয়ে রক্তক্ষয় করেন। শিকার হয় সাধারণ মানুষ। স্বার্থাণ্বেষীদের হয়ে অস্ত্র ধরে সাধারণ মানুষেরাই। রক্ত দেয়, জীবন দেয়, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সোনালী যৌবন বিলিয়ে দেয় তথাকথিত দেশপ্রেমের নাম করে, জাতির, গোষ্ঠীর সম্মান রক্ষার নামে। যুদ্ধশেষে এই বীরেরাই আবার উপেক্ষার শিকার হয়। মাঝখান থেকে লাভবান হয় অন্যরা আর ক্ষতিগ্রস্তরা পড়ে থাকে অবহেলায়, দুঃখ-দুর্দশায় আর অতিবাহিত করে নিগৃহিত, নিঃস্ব জীবন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১২