ব্রাহ্মণবাড়িয়া: সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষাকে অস্বীকার করেছিল পাকিস্তানিরা। বীর বাঙালির আন্দোলনে ঘি ঢালে জিন্নাহর ঘোষণা।
কিশোর তাজুল নিজেও নেমে পড়লেন রাস্তায়। মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে দীপ্ত কণ্ঠে স্লোগান তুললেন-‘রাষ্ট ভাষা বাংলা চাই...’। তবে আর দশজন ভাষা সংগ্রামীর সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাজুলের পার্থক্য আছে। কারণ তিনি নিজে উর্দুভাষী। অথচ লড়াই করেছেন বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ে!
তাই তার খোঁজে বের হওয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের হালদার পাড়ার বাসায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন প্রবীন মানুষটি। বয়স ৮০ ছাড়িয়ে গেছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তাজুল ইসলামের সঙ্গে বাংলানিউজের পক্ষে কথা বলার অনুমতি চাইলে অনেকক্ষণ দরজায়ই নিশ্চুপ দাাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
আপনিই কি তাজুল ইসলাম? এমন প্রশ্নে তন্দ্রা ভাঙ্গে তার। বললেন, আমিই তাজুুল ইসলাম। কিন্তু আমার সঙ্গে তো কেউ কথা বলতে আসে না! পরে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় তার সঙ্গে।
বয়সের ভারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রোগে অনেকটাই শ্রান্ত তিনি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের কথা উঠতেই যেন ফিরে গেলেন বায়ান্নর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে। চোখে যেন জ্বল জ্বল করে ভাসতে থাকে সেই রক্তঝড়া দিনগুলো।
তাজুল ইসলাম জানান, তখন তিনি কলেজিয়েট স্কুলের (বর্তমানে নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়) ৯ম শ্রেণীর ছাত্র। অনেকের কাছ থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির বিষয়টি শুনেছিলেন। উজ্জীবিত হন নিজেও। তার মতে লাখো বাঙালির এটা ছিল প্রাণের দাবি। এ রাষ্ট্রে বাংলাভাষী ছিল বেশি।
কিন্তু সরকার অন্যায়ভাবে তাদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আরবি হরফে বাংলা লেখা হবে এমন কথাও বলা হচ্ছিল। কিন্তু তাতো অন্যায়।
তাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ভারতের উত্তর প্রদেশে হওয়ায় আমাকে কেউ সন্দেহ করত না। বাসার সবাই তখনও উর্দুতে কথা বলতো। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জুবলি প্রেস থেকে পোস্টার আনা। মিছিলের জন্য লোক জমায়েত করাসহ নানা কাজ করতাম আমি। যোগ দিতাম মিটিং মিছিলে। তবে এ কাজে পরিবারের সদস্যরাও আমাকে সমর্থন করে।
তিনি বলেন, ‘জনমত গড়ে তুলতে আমাকে দিয়ে বিভিন্ন লিফলেট বিতরণ করা হতো। ট্রেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে থামলে দৌঁড়ে বগিতে বগিতে বাংলার পক্ষে ছাপানো লিফলেট ছিটিয়ে দিয়ে চলে আসতাম। একাজ করতে গিয়ে অনেকবার পুলিশের ধাওয়াও খেয়েছি। অনেকদিন বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছি। একবার এক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে ভয়ভীতিও দেখান। কিন্তু আমি দমে যাইনি’।
স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, একবার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিদর্শক মোহাম্মদ বশির আমার কার্যক্রম বুঝে ফেলে বলেন, ‘তুম ইয়ে কিয়া কারতা হ্যায়? ইয়ে তোম ঠিক নেহি করতা হ্যায়। ’
তার এমন বক্তব্যের পর আমি তাকে অনেক বুঝালাম। পরে তিনিও বাংলাকে রাষ্টভাষা করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের জন্য চুপ আছেন বলে জানান।
তিনি আরো বলেন, ‘আমি ছিলাম মৌলভী টাইপের। আন্দোলনরতদের মধ্যে উকিল আব্দুল বারী আমাকে মসজিদে মসজিদে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। মসজিদে গিয়ে মুসল্লি¬¬দের বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে বলি। কবি আল মাহমুদ, মুহম্মদ মুসাসহ আরও অনেক সহপাঠী আমাকে এ কাজে সাহায্য করেছেন। ’
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘এখন প্রায় সময় বাংলা ভাষার বিকৃত ব্যবহার দেখি। তাছাড়া বানানেও রয়েছে ভিন্নতা। যা ভাষা সংগ্রামী হিসেবে অন্য সবার মত আমাকেও পীড়া দেয়। ফেব্রুয়ারি এলে সবাই বাংলা বাংলা বলে পাগল হয়ে যায়।
তার বক্তব্য, একুশে ফেব্রুয়ারির পর সবার মাথায় যেন বরফ পড়ে যায়। কেউ আর বাংলার জন্য কথা বলেননা। ফলে এখনও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন করতে পারিনি আমরা। ঠেকাতে পারিনি ভাষার বিকৃত ব্যবহার। তিনি ভাষার বিকৃত ব্যবহার ঠেকাতে বাংলা একাডেমীকে আরও শক্তিশালী করার দাবি জানান।
ব্যক্তিগত জীবনে তাজুল ইসলাম ছিলেন শিক্ষক। নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় তিনি শিক্ষকতা করেছেন ২ যুগেরও বেশি সময়। তিনি চার মেয়ে এবং এক ছেলে সন্তানের জনক। ইতোমধ্যে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করে বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলেও উচ্চ শিক্ষিত। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছেন।
বর্তমানে তার বাড়ির সবাই বাংলা ভাষাভাষী। বাংলাকে তিনি লালন করেন। তার বন্ধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা সৈনিক মুহম্মদ মুসা বাংলানিউজকে বলেন, ‘তাজুল আমাদের সহপাঠী ছিলেন। তার মতো উর্দু ভাষার কেউ বাংলার জন্য লড়বে এটা ভাবতেই অবাক লাগে। তার দেখাদেখি আরও অনেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তখন সোচ্চার হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১২