ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

অনিশ্চিত জীবন যাত্রা শিল্পীদের

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫১, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১২
অনিশ্চিত জীবন যাত্রা  শিল্পীদের

ঢাকা : ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার খাটরা গ্রামের শামীম হোসেন (৩৫) স্কুলজীবনে শখের বশে যোগ দিয়েছিলেন যাত্রার দলে। পরিণত বয়েসে এসেও ভাল লাগার ভাটা পড়েনি এতটুকু।



যাত্রাশিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে শামীম হোসেন বাংলানিউজকে জানান, দেশের সিংহভাগ যাত্রাশিল্পীর অবস্থান গ্রামে। দেশের সংস্কৃতিকে ভালোবেসে যাত্রাশিল্পের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার পর অনেকটা আবেগেই অন্য কোনো পেশায় যাওয়ার কথা ভাবেননি সংস্কৃতিপ্রেমিক মানুষগুলো।

এক সময় গ্রামাঞ্চলে যাত্রানুষ্ঠান, জারি-সারি-কবিগান ছাড়া বিনোদনের অন্যকোনো মাধ্যম ছিল না। একমাত্র এই বিনোদনই সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতো।

শামীম হোসেনের মতে, ধীরে ধীরে টেলিভিশন, সিনেমাহল ও বিনোদনের অন্য মাধ্যমগুলো সহজলভ্য  হলেও যাত্রার জনপ্রিয়তায় কোনো প্রভাব পড়েনি।

যাত্রানুষ্ঠান আয়োজনের ওপর নানাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলেও গত দু’দশকে এ শিল্পের ওপর লাগাতার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। ফলে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে বাংলা সংস্কৃতির প্রাচীন এ শিল্প মাধ্যম ও এর সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের জীবন-জীবিকা।

অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ও অন্য পেশার সঙ্গেও যুক্ত -এমন যাত্রাশিল্পীরা ভাল থাকলেও চরম দুর্দিন পার করছেন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক যাত্রাশিল্পী। জীবনের শেষ বয়েসে এসে অনেক যাত্রাশিল্পীর অসুস্থ হয়ে ভিক্ষুকের মতো হাত পাতা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

তার মতে, যাত্রা শিল্পের চলমান সংকট দূর করা না গেলে এক সময় ডাইনোসরের মতোই বিলুপ্ত হবে বাংলার যাত্রা।  

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সহায়ক ভূমিকা রাখায় মুকুন্দ দাসের স্বদেশী যাত্রা বন্ধে ১৯৩৩ সালে ‘বেঙ্গল প্লেস অফ পাবলিক অ্যামিউজমেন্ট অ্যাক্ট’ প্রবর্তিত হয়।

পরবর্তীতে দেশের স্বাধীনতার জন্য গণআন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও স্বাধীন দেশে যাত্রার জন্য কোনো সুসংবাদ মেলেনি।

যাত্রাদল গঠনে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয়। পালা পরিবেশনের জন্যও অনুমতি নিতে হয় জেলা প্রশাসকের কাছ থেকেই। নতুন করে অনুমতি নিতে হয় অন্য জেলায় গেলে।

সংশ্লিষ্ট থানা থেকে প্রতি রাতের জন্য পৃথক অনুমতি নিতে হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নাটক, চলচ্চিত্রসহ অন্যান্য মাধ্যমকে রাখা হলেও বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় যাত্রাকে রাখা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত করে।

এসব প্রশাসনিক ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াও এ শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশের অন্তরায় চিহ্নিত করা গেছে বেশ কিছু মোটা দাগের কারণ।

রয়েছে যাত্রাশিল্পীদের বঞ্চনার নানা ইতিকথা। যাত্রাপালা অষ্টাদশ শতক থেকেই সুদৃশ্য মঞ্চে অনুষ্ঠিত হতো। সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এক সময় যাত্রায় সখিনৃত্যের প্রচলন ছিল।

সময়ের বিবর্তনে বর্তমান সময়ে এসে এটি পরিণত হয়েছে অশ্লীল নৃত্যে। প্রশাসনিক অনুমতির বেড়াজাল পেরিয়ে মূলধারার সাধারণ যাত্রা প্রদর্শকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামর্থ্য হন না যাত্রানুষ্ঠান আয়োজনে।

এই সুযোগে এক শ্রেণীর বিকৃত মানসিকতার মুনাফালোভী প্রদর্শক গড়ে ওঠে। তারাই সুশৃঙ্খল বিনোদন মাধ্যম যাত্রায় আমদানি করেন অশ্লীলতা, জুয়া, হাউজি ও মাদকসেবনের মতো অপরাধ কর্মকাণ্ড।

যাত্রাশিল্পী ও গবেষকদের মতে, বর্তমানে এ অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যাত্রাশিল্পীদের কেবল নামমাত্র রাখা হয়- শুধু অনুষ্ঠানের অনুমতি লাভের জন্য।

অনেক ক্ষেত্রে তাদের অভিনয় মঞ্চেও উঠতে দেওয়া হয় না-সেখানে চলে যাত্রার নামে অন্য কিছু। যাত্রাশিল্পীদের রঙিন সাজে সজ্জিত করে বসিয়ে রেখে চুক্তির টাকা দেয়া হয়।

যাত্রাশিল্পীদের দাবি- বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় কিংবা নিজেদের পালা আয়োজনের সামর্থ্য না থাকায় বাধ্য হয়েই এ অন্যায় মেনে নিতে হয় শিল্পীদের। প্রকৃতপক্ষে অশ্লীলতা বা অন্যসব অপরাধকর্মে কোনো সম্পৃক্ততা নেই তাদের।

চলমান এসব সংকট ও  আর্থিক নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির  কারণে নতুন শিল্পী এক রকম তৈরি হচ্ছে না বললেই চলে। যারা শৈশব থেকেই জড়িত হয়েছেন যাত্রায়, তাদেরও অনেকে সন্ধান করছেন নতুন পেশার।
যাত্রাশিল্পের বিরাজমান নাজুক পরিস্থিতি হয়েছে অনেকটা যাত্রাশিল্পীদের নিজেদের দোষেই। কারণ, প্রাচীন এ সাংস্কৃতিক মাধ্যমটিতে অশ্লীলতা ঢুকিয়ে, এর মাধ্যমে সংকুচিত করা হয়েছে শিক্ষা গ্রহণের জায়গাটি।

অনেক ক্ষেত্রে যাত্রাশিল্পীরা নিজেরা দায়ী না হলেও একে প্রতিহত করার জোরালো চেষ্টাও নেই তাদের মাঝে। যাত্রাশিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে এভাবেই নিজের মূল্যায়ন তুলে ধরেন দেশের প্রথিতযশা নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ।

মামুনুর রশীদ বাংলানিউজকে জানান, ‘মৌলবাদীরা চায় না যাত্রাশিল্প বিকশিত হোক। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই এক সময় যাত্রাশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ একে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে নানা টানাপড়েন সত্ত্বেও এ শিল্পে কিছু নিবেদিত কর্মী রয়েছেন। আমরা তাদের সঙ্গে রয়েছি।

তিনি আরো জানান, এ শিল্পের সহযোগিতার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি কমিটি হয়েছে।

আমি নিজেও এ কমিটির সদস্য। এ শিল্পের জন্য বেশ কিছু কল্যাণকর নীতিমালা সংবলিত একটি প্রজ্ঞাপন খুব শিগগিরই জারি হবে বলে আশা করছি। যার মাধ্যমে যাত্রাশিল্প আবার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হবে বলে তিনি মনে করেন।     

যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে কিছু সুপারিশ : ড. তপন বাগচী। একাধারে কবি ও গবেষক। যাত্রাশিল্পের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। যাত্রাশিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনার ওপর ভিত্তি করে তিনি একটি সুপারিশমালা তৈরি করেছেন ।

এই গবেষকের দৃঢ় আশাবাদ এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে যাত্রাশিল্পের সংকট দূর হবে। আমাদের শেকড় এশিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

এসব সুপারিশ মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমকালীন বিষয় নিয়ে যাত্রাপালা রচনার জন্যে দেশীয় পালাকার ও নাট্যকারদের উদ্যোগী হওয়া। মাসে ‍অন্তত একবার মহিলা সমিতি কিংবা জাতীয় নাট্যমঞ্চে যাত্রানুষ্ঠানের সুযোগ সৃষ্টি করা।

বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত যাত্রানুষ্ঠান প্রচার। সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে যাত্রাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার ও শিল্পকলা একাডেমীর জেলা শাখাগুলোতে নিয়মিত যাত্রা মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা।

এছাড়া যাত্রা শিল্পের স্থায়ী উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন বোর্ড গঠন। যাত্রানুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে ‘বেঙ্গল প্লেস অব পাবলিক অ্যামিউজমেন্ট অ্যাক্ট- ১৯৩৩’ বাতিল করা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা বিবিধ।

বাংলাদেশ সময় : ১৭৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।