ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

যীহিক্সেল বালার চাতাল স্কুল

একরামুল কবীর, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১৮, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১২
যীহিক্সেল বালার চাতাল স্কুল

গোপালগঞ্জ: সিমেন্ট বাঁধানো ধানের চাতাল। সন্ধ্যা নামলেই শহরের নানা প্রান্ত থেকে শিশুরা সেখানে জড়ো হয়।

ওদের কল-কাকলীতে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। এ যেন অন্ধকার রাতে তারার মেলা।

দারিদ্র্যের কারণে ওদের জামা-কাপড় অপরিচ্ছন্ন, চেহারা মলিন। কিন্তু শিক্ষার আলোয় ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে মেধা ও মনন।

যীহিক্সেল বালার নৈশ চাতাল স্কুল ‘পথশিশু নিকেতন’ তাদের জীবনকে এভাবে পরিবর্তন করছে। গোপালগঞ্জ শহরের টোকাই শিশুদের স্বাস্থ্য-শিক্ষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে স্কুলটি।

এ স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী চাতাল শ্রমিক পরিবারেরর সন্তান। শুক্রবার বাদে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় বসে এ স্কুল। চলে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। জাতীয় সংগীত ও স্কুল সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাঠদান।

যীহিক্সেল বালা সামান্য টেম্পুচালক। কিন্তু তিনি স্থাপন করেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ২০১০ সালের ৪ অক্টোবর শহরের বেদগ্রামের ফায়ার সার্ভিস রোডের বিসিক শিল্প নগরীর কাছে লতিফপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলামের ধানের চাতালে স্কুলটির কার্যক্রম শুরু করেন।

৪৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। ২ বছরের ব্যবধানে বর্তমানে ১৫৩টি টোকাই শিশু এখানে পড়ালেখা শিখছে। এর মধ্যে শিশু শ্রেণীতে ৩৭ জন, প্রথম শ্রেণীতে ৫৫ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ১৯ জন, তৃতীয় শ্রেণীতে ১৭ জন, চতুর্থ শ্রেণীতে ১৭ জন, পঞ্চম শ্রেণীতে ৭ জন এবং ষষ্ঠ শ্রেণীতে ১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

তবে স্কুলটির নেই কোনো ঘর। চট বিছিয়ে একটি মাত্র লাইটের আলোয় এসব শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে।

স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা যীহিক্সেল বালা নিজে টেম্পু চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি নিজে এবং সামান্য বেতনে ২ জন শিক্ষক দিয়ে মহৎ কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। সামান্য ঝড়-বৃষ্টি বা ঘন কুয়াশায় বন্ধ রাখতে হয় স্কুলটি।

যীহিক্সেল বালা বাংলানিউজকে জানান, প্রথমে চাতাল শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এ স্কুল শুরু করেন। পরে আশপাশের দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়ে ও টোকাইয়ের কাজ করতো এমন শিশুদের বুঝিয়ে স্কুলে আনা হয়েছে।

এতে শহরের টোকাই অনেকটা কমে গেছে। টোকাই কমার কারণে ছোট-খাটো চুরিও কমেছে। স্কুলটিতে সরকারি-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান করা হয়।

তিনি জানান, জেলা শিক্ষা অফিস থেকে সরকারি পাঠ্য বই দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে। পাঠদান শেষে স্কুলে শিক্ষার্থীদের টিফিন দেওয়া হয়। প্রতিমাসে একবার শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়।

এ স্কুলে পড়ে অনেক ছেলে-মেয়ে এখন টোকাইয়ের কাজ ছেড়ে বিভিন্ন ছোট-খাটো ব্যবসায় নেমেছে। টেম্পু চালকের আয়ের টাকায় এ স্কুলের কার্যক্রম চলছে। তিনি আয়ের অর্ধেক টাকা ব্যয় করেন স্কুলে। তার নিজের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়।

যীহিক্সেল বালার স্ত্রী একটি খ্রিস্টান মিশনারিজ স্কুলে শিক্ষকতা করেন। দুইজনের আয়ে চলে তাদের সংসার। স্কুলটি চালাতে এ মানুষটিকে খুব কষ্ট পোহাতে হয়। তারপরও তিনি মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।

স্কুলটির শিক্ষার্থী আলী আকবর, মামুন, ফাতেমা, খায়রুল বললো, ‘আগে আমরা শুধু টোকাইয়ের কাজ করতাম। সবাই আমাদের টোকাই বলতো। লেখা-পড়া জানতাম না। সারা শহর টুকিয়ে ৪০-৫০ টাকা আয় হতো’।

ওদের ভাষায়, ‘চাতালে স্কুল হওয়ায় আমরা পড়া লেখা শিখছি। এখন আমরা নাম-ঠিকানা লিখতে পারি। আর এটা সম্ভব হয়েছে যীহিক্সেল স্যারের আশীর্বাদে’।

অভিভাবক মমতাজ বেগম, দিপু দত্ত, লাভলী বেগম, রেহানা বেগম, নাজমা বেগম ও রিপন মোল্যা বলেন, ‘চাতালে কাজ করে সন্তানদের তিন বেলা খাবার দিতে কষ্ট হয়। তাই ওরা যা আয় করে, সব মিলিয়ে কষ্টে দিন চলে যায়। এতোদিন বাচ্চাদের পড়া-লেখা শেখাতে পারিনি। যীহিক্সেল স্যার আমাদের সন্তানদের কথা চিন্তা করে একটি নৈশ স্কুল করেছেন। এখন সবারই বাচ্চা ওই স্কুলে পড়ে। এখন ওরা দেশের জন্য কিছু করতে পারবে’।

প্রতিষ্ঠাতা যীহিক্সেল বালা বললেন, ‘অনেক ছোট ছোট শিশু বাজার, রাস্তা-ঘাট ও বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সবজি, কাগজ, পলিথিন, পুরনো জিনিসসহ অন্যান্য মালামাল কুড়িয়ে নিয়ে ভাঙ্গাড়ির (পুরনো মালামালের আড়ত) দোকানে বিক্রি করে। এভাবে সারাদিন পরিশ্রম শেষে ৩০৪০ টাকা আয় করে’।

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় তারা ছোট-খাট চুরির সঙ্গে জড়িয়ে মারপিটের শিকার হয়। এ সব ঘটনা অনেক বার আমার সামনে  ঘটেছে। তখন থেকেই আমার চিন্তা ছিল এসব শিশুর জন্য কিছু করার। তাই ২০১০ সালে টোকাই শিশুদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পথশিশু নিকেতন নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করি’।

‘তখন শুধু টোকাই শিশুরা পড়াশোনা করলেও বর্তমানে কিছু হতদরিদ্র পরিবারের শিশুও এখানে পড়াশোনা করছেন। এখন আমি অনুভব করছি ওদের জন্য একটি স্থায়ী স্কুল দরকার। এ কাজে আমি সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতার আহবান জানাচ্ছি’।
গোপালগঞ্জর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লক্ষ্মণ কুমার দাস বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছিন্নমূল পরিবারের শিশুরা টোকাই। অনেকের বাবা-মা তাদের খোঁজ-খবর রাখেন না। অনেকের বাবা-মার বিচ্ছেদ হয়েছে। তারা আবার বিয়ে করেছেন। তাদের দেখার কেউ নেই’।

তিনি জানান, এসব শিশুদের নিয়ে একটি স্কুল করেছেন যীহিস্কেল বালা। প্রথমে তিনি একাই উদ্যোগ নিলেও পরে কিছু লোক তাকে সামান্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর (শুক্রবার ব্যতীত) এদের ২ ঘণ্টা শিক্ষা দেওয়া হয়। চলে পড়া-শোনা ও গান-বাজনা ও গল্প।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এদের মধ্যে যারা ভালো, তাদের বিকেলে সরকার পরিচালিত শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট স্কুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যাতে তারা সম্পূর্ণভাবে প্রাতিষ্ঠান শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে’।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।