ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

চরম দুর্দিন পার করছেন যাত্রাশিল্পীরা

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৫২, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১২
চরম দুর্দিন পার করছেন যাত্রাশিল্পীরা

ঢাকা: নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়ে চরম দুর্দিন পার করছে দেশের প্রাচীন শিল্প মাধ্যম ‘যাত্রা’। এ শিল্পের যুক্ত কয়েক লাখ শিল্পী ও কলাকুশলী।



সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন-ধারণের সব উপকরণের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম সাধ‍ারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।

বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের মত যাত্রা শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও এই কঠোর জীবন সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন। এমন পরিস্থিতির কারণে শিল্পীদের কেউ কেউ অন্য পেশারও সন্ধান করছেন।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ি, দেশে বর্তমানে শিল্পী-কুশলী-কর্মচারী, দল মালিক, ব্যবস্থাপক, পালাকার, প্রদর্শক ও তাদের পরিবার পরিজনসহ যাত্রানুষ্ঠ‍ানের আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক।

প্রতিটি যাত্রাদলের সদস্য সংখ্যা ৭০-৮০ জন। এরমধ্যে শিল্পী ৫০-৫৫ জন, পুরুষের সংখ্যা ৩০-৩৫, মহিলা ১৫-১৮ জন। শিশু শিল্পী থাকে কমপক্ষে ২ জন। অবশিষ্টরা দলের বিভিন্ন দায়িত্বে সাংগঠনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। যাত্রাপালা একটি মৌসুমি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অর্থাৎ সারা বছর ধরে এটি অনুষ্ঠিত হয় না। পেশাদার যাত্রাপালা আয়োজনের সময়সীমা ছয় থেকে সাত মাস।  

জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণের মাঝামাঝি অর্থাৎ মে, জুন, জুলাই– এই তিন মাস আসন্ন মৌসুমের জন্য প্রত্যেক দলের সাংগঠনিক প্রস্তুতিকাল। এ সময়ে লাইসেন্স গ্রহণ, নবায়ন, পুঁজি সংগ্রহ, শিল্পী-কলাকুশলী সংগ্রহ ও চুক্তিকরণ, পালা নির্বাচন, বাক্সপেটরা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অন্য সামগ্রী সংগ্রহ এবং মেরামত করা হয়।

শ্রাবণের শেষ ভাগ থেকে ভাদ্রের শেষ ভাগ (আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) যাত্রাপালার মহড়াকাল। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রার মৌসুম শুরু হয় দূর্গা পুজোর সপ্তমীর দিন থেকে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের শেষ কিংবা অক্টোবরের প্রথম দিকে। যাত্রানুষ্ঠান আয়োজনের সমাপ্তি টানা হয় চৈত্রের শেষের দিকে অর্থাত এপ্রিলের মাঝামাঝি।  

যাত্রাশিল্পী ও কলাকুশলীদের আয়-রোজগার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিলন কান্তি দে বাংলানিউজকে জানান, ‘পেশাদার যাত্রাদলের শিল্পী-কলাকুশলীসহ সকল কর্মচারী কেবলমাত্র একটি মৌসুমের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন।

বিভিন্ন দলের চুক্তিপত্র প্রণয়নে ভিন্নতা থাকলেও চুক্তিপত্রের শর্তাবলী প্রায় ক্ষেত্রেই একই রকম। চুক্তি অনুযায়ী নায়ক-নায়িকাসহ প্রধান চরিত্রের শিল্পীদের ক্ষেত্রে দুই থেকে আড়াই মাস এবং সাধারণ মানের শিল্পীদের ক্ষেত্রে দেড় মাসের বেতন অগ্রিম দেবার প্রচলন আছে। চুক্তিপত্রের  সময় সংশ্লিষ্ট শিল্পীকে সামান্য সাইনিং মানি দেয়া হয়।

তিনি আরো জানান, সাধারণতঃ ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’-এই তিন ক্যাটাগরিতে শিল্পী এবং কলাকুশলীদের এক মৌসুমের বেতন নির্ধারণ করা হয়। কোন পালার নায়ক-নায়িকা, পরিচালকসহ প্রধান চরিত্রের শিল্পীদের ধরা হয় ‘এ’ ক্যাটাগরিতে।

প্রতি মৌসুমের জন্য তাদের প্রত্যেকের বেতন হয় ৬০-৭০ হাজার টাকা। কৌতুক অভিনেতা, সহ-অভিনেত‍াদের ধরা হয় ‘বি’ ক্যাটাগরিতে। আর তাদের বেতন ৩৫-৪০ হাজার টাকা। সাধারণ শিল্পী ও নবাগতদের ধরা হয় ‘সি’ ক্যাটাগরিতে। এই ক্যাটাগরির শিল্পীদের দেয়া হয় ২০-২৫ হাজার টাকা।

নির্ধারিত অগ্রিমের সমুদয় অর্থ পাওয়ার পর পরই শিল্পীরা নিজ নিজ দলের ‘মহড়া বাড়িতে উঠে আসেন। নতুন পালার অভিনয় এবং নৃত্যগীতের রিহার্সেল চলে টানা দেড় মাস পর্যন্ত। এই মহড়া বাড়িতে এসে দল বায়না করেন প্রদর্শকরা। যাত্রার ভাষায় যাদের বল‍া হয় ‘নায়েক পার্টি’।  

গবেষণা গ্রন্থের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে অর্ধশতাধিক পেশাদার যাত্রাদল ও শতাধিক হাফ-যাত্রা বা ঘেটুযাত্রা দল রয়েছে। পেশাদার যাত্রা দলের বাইরে এসব ছোট ছোট দলগুলোর আয়-রেজগার খুব বেশি নয়। দর্শকদের দেয়া সামান্য ‘বকসিশ’ পেয়েই খুশি এসব শিল্পীরা।

অনেক সাধারণ যাত্রা শিল্পীদের অভিযোগ- নায়েক পার্টির কাছ থেকে অধিক পরিমাণ অর্থ নেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট পালা মালিক বা পরিচালক পারিশ্রমিক দেয়ার ক্ষেত্রে সুবিচার করেন না। কেন্দ্রীয় চরিত্রের শিল্পীদের পারিশ্রমিক দেয়ার পর সাধারণ শিল্পীদের অতি সামান্য টাকা দেয়া হয়।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুর দাম বাড়লেও যাত্রাশিল্পীদের রোজগার বাড়েনি। এর ফলে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে তাদের জীবনযাত্রা। কেবল আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভেবেই অনেক পেশাদার যাত্রাশিল্পী বিকল্প পেশায়ও চলে যাচ্ছেন।  
 

পালা আয়োজন: বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কম বেশি যাত্রাদল রয়েছে। তবে পেশাদার যাত্রাদলের বেশির ভাগই শহর কেন্দ্রীক। এসব যাত্রাদল প্রদর্শক বা আয়োজকদের   সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অভিনয় করে থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আয়োজকরা পাল‍া মঞ্চায়নের জন্য যাত্রা পরিচালক বা মালিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন।

যাত্রা মালিকের সঙ্গে কথা পাকাপাকি করেই পালা আয়োজনের বাকি কাজ শুরু করেন আয়োজক পক্ষ। যাত্রাদলের কোন সদস্যের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে পালা প্রধান ছাড়াও অন্যকোন শিল্পীর মাধ্যমেও হতে পারে এ চুক্তি।   যাত্রা শিল্পীদের একাধিক সংগঠনও রয়েছে। এসব সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মাধ্যমেও পালা মঞ্চায়নের চুক্তি হয়ে থাকে।

মৌখিক ও লিখিত দু’ভাবেই আয়োজকদের সঙ্গে যাত্রাপালার চুক্তি হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৌখিক চুক্তিতেই অভিনয়ে সম্মত হয় যাত্রাশিল্পীরা। তবে এক্ষেত্রে অগ্রিম পারিশ্রমিক নেয়ার বিধান চালু রয়েছে।

উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহর এবং জাতীয় পর্যায়ে যাত্রাশিল্পীদের সংগঠনের অফিসে এসেও পালা মঞ্চায়নের জন্য পছন্দের দল বাছাই করতে পারেন আয়োজকরা।
 
 জেলায় জেলায় নিবন্ধনকৃত যাত্রাদল: দেশের ৬৪ জেলার ২১টিতে কোন নিবন্ধনকৃত যাত্রাদল নেই। ২১ জেলাগুলো হলো– পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, নবাবগঞ্জ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, পিরোজপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি।

বাকি ৪৩ জেলায় নিবন্ধনকৃত যাত্রাদল রয়েছে। এর মধ্যে নওগাঁ, রাজশাহী, পাবনা, বরগুনা, ভোলা, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, চাঁদপুর, ফেনী ও লক্ষীপুর- এই ১০ জেলায় যাত্রাদল রয়েছে ১টি করে।

২টি করে যাত্রাদল রয়েছে-শরিয়তপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পটুয়াখালী, জামালপুর ও হবিগঞ্জে। রংপুর, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নড়াইল, নরসিংদী, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলায় যাত্রাদল রয়েছে ৩টি করে। গাজীপুর জেলায় যাত্রাদলের সংখ্যা ৪টি।

৫টি করে যাত্রাদল রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মাগুরা জেলায়। বাগেরহাট, নেত্রকোণা ও চট্টগ্রামে রয়েছে ৬টি করে। ৭টি করে যাত্রাদল রয়েছে নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলায়।

ময়মনসিংহ ও বরিশালে রয়েছে ৮টি করে। ঝালকাঠি ও ফরিদপুরে রয়েছে ৯টি করে যাত্রাদল। সাতক্ষীরায় ১০টি এবং গোপালগঞ্জ ও ঢাকা জেল‍ায় এ সংখ্যা ১২টি করে। সবচে’ বেশি রয়েছে খুলনায় ১৩টি। যশোরে ১৭টি ও মানিকগঞ্জে ২২টি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।