ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘সুন্দরবন মায়ের মতন’-প্রচারাভিযান

ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করার আন্দোলন

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৫২, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২
ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করার আন্দোলন

সুন্দরবন অঞ্চল থেকে ফিরে: আমাদের জীবন ও প্রকৃতির সুরক্ষা দানকারী সুন্দরবনের বিপন্নপ্রায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ এর প্রাণীবৈচিত্র্যকে রক্ষায় পাঁচ বছরব্যাপী এক গণসচেনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি পরিচালনা করছে বেসরকারি সংগঠন ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ। সংগঠনটির টাইগার প্রজেক্টের উদ্যোগে এ কর্মসূচির আওতায় নানা অনুষ্ঠানমালা ও উদ্যোগ শুরু হয়েছে সম্প্রতি।



এ প্রচারাভিযানের শিরোনাম হচ্ছে ‘সুন্দরবন মায়ের মতন’।      

টাইগার প্রজেক্টের সংগঠক জানান, ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ-বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সুন্দরবন ও এর প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টি এ প্রতিষ্ঠানই ব্যাপক ভাবে প্রচার করে আসছে শুরু থেকে। এর ধারাবাহিকতায়ই এ প্রতিষ্ঠানের সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট সম্প্রতি পাঁচ বছরব্যাপী ওই জনসচেতনতা কার্যক্রম শুরু করেছে।

কর্মসূচির প্রেক্ষাপট

নিজের জীবনকে বিপন্ন করে মা তার সন্তানকে রক্ষা করেন- ভালোবাসা আর আত্নত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে বিরল নয়। দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশের জন্য সুন্দরবনকেও একই বিবেচনায় আনলে ভুল হয় না। শত দূর্যোগ থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে নিজের বুক পেতে সুরক্ষিত করে আসছে এ বন।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার প্রধান উৎসহ সুন্দরবন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের ক্রমাগত নিজের ঐশ্বর্য আর সম্পদ বিলিয়ে দিতে দিতে সুন্দরবন ক্রমেই নিঃস্ব হতে চলেছে।

আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে সুন্দরবন সর্বস্ব দিতে কৃপণতা না করলেও আমরা মোটেও যত্নবান হইনি একে সুরক্ষায়। প্রজেক্টে কর্মরত বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, প্রাকৃতিক কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হয়েছে সামান্যই। বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের বহুমাত্রিক সংকটের বেশির ভাগই হয়েছে মানবসৃষ্ট কারণে।

জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত চাপ, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ সর্বোপরি সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার তুঙ্গে থাকা জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকির কারণে সুন্দরবনের গুরুত্ব বা অপরিহার্যতা বেড়েছে বহুগুণে। তাই সুন্দরবনের চলমান সংকট ও সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি নানামুখী তোড়জোর চলছে।

এসব বিভিন্ন উদ্যোগের ধরণ বা কাজের ভিন্নতা থাকলেও প্রায় সকলেই মনে করছেন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত না করলে সব উদ্যোগেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। স্থানীয়দের বনজ সম্পদ ও বন্যপ্রাণী ধ্বংসের মনোভাব থেকে রক্ষার মানসিকতা তৈরি করাই অন্য কিছু থেকে বেশি জরুরি মনে করছেন সবাই।

টাইগার প্রজেক্ট এ কারণেই বিশেষত: বাঘ বাঁচানোর লক্ষ্যে স্থানীয়দের জনসচেতনতা বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

বাঘ: বিপন্ন হবার ইতিহাস
 
১০০ বছর আগেও পুরো বাংলাদেশ জুড়ে অন্যসব বন্যপ্রাণীর মতো বাঘের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। ঢাকার পার্শ্ববর্তী ভাওয়াল ও মধুপুর বনাঞ্চলেও বাঘের সংখ্যা ছিল উল্লেখ করার মতো।

কিন্তু নির্বিচারে শিকার ও বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে বাঘের সংখ্যা কমে এসেছে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে। বর্তমানে কেবলমাত্র সুন্দরবনেই বাঘের দেখা মেলে। এ অবস্থার আরো অবনতি ঠেকাতে পুরনো আইন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে বিশেষজ্ঞদের মত।

মানুষের অভ্যাস ও পুরনো রীতির কিছু ধারণা, যেমন: হরিণের মাংসের কেনা বেচা ও শিকার, লোকালয়ে ঢুকে পড়া বাঘ হত্যা বাংলাদেশের রাজকীয় এ প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যপ্রাণী বিশেষ করে, বাঘের প্রতি এই আচরণ বদলে দিতেই ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ-এর সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট কাজ শুরু করেছে।

আগে থেকেই চলে আসা বন ধ্বংস ও বন্যপ্রাণী নিধনের অভ্যাস একদিন বা একমাসে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এ কারণেই সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট মনে করছে, একটি সুরক্ষা জাল তৈরি করা প্রয়োজন এই এলাকা ঘিরে।

যে ভাবে প্রজেক্টের বাস্তবায়ন

বিশেষ এই প্রজেক্ট প্রচারণার শুরুতে সুন্দরবনকে ঘিরে থাকা ৫টি জেলার (সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনা) ২৬টি ইউনিয়নে শুরু করতে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম। এ সমস্ত এলাকায় চার বছরের প্রচারণার পর অন্যান্য এলাকায় বিস্তৃত হবে এ কার্যক্রম। পঞ্চম বছরে জঙ্গলের পার্শ্ববর্তী ৮ উপজেলার সকল ইউনিয়নে চালানো হবে প্রচারাভিযান।

ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম বাংলানউজকে বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে দুর্গম এলাকা হলো আমাদের এই প্রচারণার স্থান, যেখানে গণযোগাযোগের মাধ্যম নেই বললেই চলে। এখানে তাদের কাছে আমাদের বক্তব্য পৌঁছানোর উপায় হলো, প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলা। এই প্রচারণা বিভিন্ন এলাকা ও উপলক্ষগুলোকে কেন্দ্র করে হবে, যার ফলে প্রচুর মানুষকে আকর্ষণ করা যাবে (যেমন: সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হাট-বাজার)।

তিনি জানান, প্রথম বছরে ১০০টিরও বেশি হাট-বাজার কেন্দ্রিক কমিউনিটি ক্যাম্প আয়োজন করা হবে প্রচারণা এলাকায়। গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন কিছু কার্যক্রমের  (যেমন: নৌকা বাইচ) আয়োজন করা হবে, যাতে প্রচারণার মূল বক্তব্য গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো আনন্দময় পরিবেশে শুনতে পারেন।

এছাড়া স্কুলের বাচ্চাদের জন্য ও গ্রামের মহিলাদের জন্য ‘বনবিবির মেলা’ আয়োজন করা হবে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে চা-চক্রের আয়োজন করা হবে, যাতে তাদের মধ্যে নতুন আদর্শের জন্ম হয়।

বছরের শেষ দিকে সাতক্ষীরা জেলার মুন্সীগঞ্জে ৩ দিনব্যাপী ‘বাঘ মেলা’ আয়োজন করা হবে। প্রথম বছরে, এ সমস্ত শিক্ষামূলক ও গঠনমূলক কার্যাবলীর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচার করা হবে সুন্দরবন ও তার জীববৈচিত্র্যকে ভালোবাসার কথা ।

তিনি বলেন, স্থানীয় মানুষ এ প্রচারণার পরবর্তী ধাপগুলোতে সরাসরি অংশগ্রহণ করবেন। প্রচারণার দ্বিতীয় বছর হচ্ছে- প্রতিশ্রুতির ধাপ, যা এলাকার মানুষকে বাঘ ও হরিণ হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি দিতে সাহস যোগাবে ও অন্যদেরও এই চর্চা করতে প্রভাবিত করবে।

তৃতীয় বছরে, স্থানীয় মানুষেরা এই প্রচারণায় সক্রিয় অংশ নেবে সংরক্ষণমূলক চেতনায়। এই পর্যায়ে গ্রামের লোকগুলোকে জঙ্গল নিরাপত্তা, দক্ষতাবৃদ্ধি, লোকালয়ে বাঘ ঢুকে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও বন্যপ্রাণী অপরাধ আইন বিষয়ে সচেতন করা হবে। প্রচারণার তিন বছর পর-মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে সংরক্ষণের স্পৃহা খুঁজে পাবেন ও সুন্দরবনের রক্ষক হিসেবে নিজেদেরকে নিয়োজিত করবেন।

ওবায়েদুল হক(৪০), সুন্দরবন অধ্যুষিত বাগেরহাটের মংলা উপজেলার বৌদ্ধমারি এলাকার বাসিন্দা। শুরু থেকে কাজ করছেন সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্টের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক টিমের লিডার হিসেবে। কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বাংলানউজকে জানান নানা কথা।

ওবায়েদুল জানান, ‘বাঘ আমাদের কেন প্রয়োজন, তা আগে বুঝতাম না। টাইগার প্রজেক্ট থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে আমরা বুঝতে পারলাম, বাঘ আমাদের ছাতার মতো। একটি বাঘ যা পারে, তিনশ’ বনকর্মীও তা পারেন না। বনবিভাগের লোক ঘুষ নিয়ে বনে যেতে দিলেও বাঘ থাকলে বনের কোনো ক্ষতি হয় না। ’

তিনি আরো জানান, ‘আমরা স্থানীয় মানুষদের বাঘ না মারতে বা বনের ক্ষতি না করতে বলছি। কিন্তু এসব মানুষের কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় তারা পেটের দায়ে বনে যান। তাদের কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারলে তারাও বনের ক্ষতি করতেন না।

ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী রক্ষায় কাজ করে আসছে ২০০৩ সাল থেকে আর সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট বাঘ রক্ষায় কাজ শুরু করে ২০০৪ সালে। এছাড়া বাঘ রক্ষার জন্য গবেষণা, বাঘ জরিপ, গ্রাম পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন ইত্যাদি কাজও করে আসছে এ প্রতিষ্ঠানটি।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।