ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

বই লেখার স্থায়ী রূপ, এটা ফাঁদও বটে!

গ্রন্থনা: শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৫৪, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১২
বই লেখার স্থায়ী রূপ, এটা ফাঁদও বটে!

প্রতিবছর বইমেলা আসলেই বই প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। এসময় বই বিক্রি ও প্রকাশ নিয়ে লেখক-প্রকাশক-পাঠকরা নানান ধরনের কথা বলেন।

বিশেষ করে তরুণরা বরাবরই বলেন, তাদের বই প্রকাশে প্রকাশকরা অনিচ্ছুক।

এবিষয়টি নিয়ে লেখকদেরই প্রশ্ন করা হলো, তরুণদের বই প্রকাশে সমস্যা ও সমাধান কী হতে পারে। তাদের উত্তর নিয়েই স্বপ্নযাত্রার এ আয়োজন।

আহমাদ মোস্তফা কামাল, কথাসাহিত্যিক

Ahmad-Mostafa-Kamalআমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন শুধু বই প্রকাশেই নয় - লেখা প্রকাশেও অনেক বাধা ছিল। তখন ব্লগ ছিলো না, ফেসবুক ছিলো না, লেখালেখির একমাত্র মাধ্যম ছিলো পত্রপত্রিকা। সেখানে সংগত কারণেই অগ্রজ লেখকদের ভিড়, স্থানের সংকট- তরুণ লেখকরা তাদের লেখা নিয়ে থাকতেন মহাবিপদে। আমরা ওই সময় সত্যিই বই প্রকাশের কথা ভাবার সাহস পেতাম না, বরং পত্রপত্রিকায় একটা লেখা প্রকাশিত হলে তাতেই দারুণ আনন্দিত হতাম।

আমাদের সময়ের কোনো লেখকই অন্তত দশ বছর লেখালেখির আগে বই প্রকাশ করতে পারেননি। এই দীর্ঘ সময় ধরে লেখালেখি করেই তারা সমসাময়িক ও অগ্রজ লেখকদের নজর কেড়েছিলেন, প্রকাশকদের কাছেও একটু-আধটু নামগুলো পরিচিত হয়ে উঠেছিল।

তরুণ লেখকদের বই প্রকাশের ব্যাপারে সবচেয়ে বড়ো বাধাটি হলো - প্রকাশকরা তরুণদের লেখালেখির তেমন একটা খোঁজখবর রাখেন না। কোনো তরুণের পান্ডুলিপি তাদের হাতে পৌঁছুলে তারা পরিচিত অগ্রজ লেখকদের কাছে জিজ্ঞেস করে থাকেন। অগ্রজরাও যদি তরুণদের নাম না জানেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশকরা বইটি প্রকাশ করার ঝুঁকি নিতে চান না।

আমি নিশ্চয়ই প্রকাশকদের এই অনুরোধ করতে পারি না যে, তারা যেন তরুণদের লেখা পড়েন! বরং তরুণদের উদ্দেশ্যে বলতে পারি - বই প্রকাশের জন্য অধৈর্য হয়ে উঠবেন না। একটা বই মানে আপনার লেখার স্থায়ী রূপ, সেই অর্থে একটা ফাঁদও বটে - সারাজীবন আপনাকে এই বইয়ের জন্য সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে যদি সেটা যথেষ্ট মানসম্পন্ন না হয়।

নিজের সব লেখাকেই প্রথম বয়সে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখা মনে হয়। কিন্তু চট করে বই প্রকাশের ঝুঁকি না নিয়ে লেখাটি দু-চার বছর ফেলে রেখে তারপর আবার পড়ে দেখুন এবং বর্তমান লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। যদি তখনও লেখাটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, তাহলে সেটিকে বইয়ের জন্য মনোনীত করতে পারেন, নইলে নয়! প্রতিভা থাকলে কেউ তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, এই কথাটি মাথায় রাখলেই নিজের ভেতরে সাহসের অভাব হবে না।

এখন যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক, তারাও একসময় তরুণ ছিলেন - আপনাদের ক্ষেত্রেও সেরকমই ঘটবে, যদি আপনারা লেগে থাকতে পারেন। লেখালেখি কোনো মৌসুমী বিষয় নয়, শৌখিন বিষয়ও নয়। একজন লেখকের জন্য লেখাই তার ধ্যান-জ্ঞান, তার জীবনযাপন। নিজেকে ওভাবে প্রস্তুত করতে পারলে বই প্রকাশের সব বাধাই দূর হয়ে যাবে, এ আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।

সালেক খোকন, আদিবাসী গবেষক ও লেখক

Salekতরুণ লেখক লেখে স্বপ্ন থেকে। সেখানে কোন লাভ কিংবা লোকসানের হিসেব থাকে না। নিজের লেখা নিয়ে সে যখন বই প্রকাশ করতে আসে তখন প্রকাশক লাভ-ক্ষতির হিসাব কষতে শুরু করে। লেখকের বই বিক্রি করে সে লাভ উঠাতে পারবে কিনা সে নিয়ে চলে দরকষাকষি।

প্রকাশক অনেক সময় লেখকের নিকট কিছু বই বিক্রি করার প্রস্তাব করে হলেও তার কাঙ্ক্ষিত লাভ উঠাতে চায় । এমন পরিস্থিতিতে একধরণের হতাশা কাজ করে তুরুণ লেখকদের মনে। অনেকের স্বপ্নই অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। লেখকদের আবেগের মাঝে চলে আসে চরম বাস্তবতা।

এই হিসেবে যাবতীয় দোষ আমরা কিন্ত প্রকাশকের কাঁধে তুলে দিতে পারিনা। প্রকাশকের দিক থেকেও তার চিন্তা পুরোপুরি অমূল নয়। এই দিক থেকে তরুণ লেখকদের প্রথম বই প্রকাশের আগে বিভিন্ন দৈনিক বা সাপ্তাহিকের সাহিত্য পাতায়, লিটল ম্যাগাজিন কিংবা ব্লগে নিয়মিত লেখা উচিত। তাহলে তার পাঠক তৈরি হবে। একজন লেখকের ক্ষেত্রে পাঠকই মূল।

আনোয়ার সাদি, সাংবাদিক ও লেখক

Anwar-Sadiপেশাদারিত্ব থাকলে বই প্রকাশ কঠিন নয়। তা তরুণদের বই হোক বা গুরুজনদেরও বই হোক না কেন। আশার কথা নানাভাবে তরুণরা এখন লেখা নিয়ে বেশি মানুষের কাছে যেতে পারছেন। সাহিত্য পত্রিকা, দৈনিক পত্রিকা বা অনলাইন মাধ্যমগুলো এই সুযোগ তৈরি করছে। লেখা পাঠক খুঁজে নেবে নাকি পাঠক লেখা খুঁজে নেবে সে বিতর্কে না গিয়ে, এককথায় বলা যায় পাঠকের সংখ্যা বাড়লে লেখক প্রকাশক উভয়ের জন্যেই আনন্দের। বই প্রকাশে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

লেখকের জন্য বই প্রকাশ-সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ, পাঠকের জন্য একটা নতুন জানালা পাওয়া যা দিয়ে দেখা যাবে অনেকদূর। প্রকাশকের জন্য বই প্রকাশ একদিকে লেখার প্রতি ভালোবাসা অন্যদিকে ব্যবসাও। কাজেই প্রকাশের আগে বইটি ব্যবসা সফল হবে কিনা, সেই বিবেচনাও প্রকাশকের মাথায় থাকতে পারে। সে বিবেচনায় কে এগিয়ে যাবেন তা বলা কঠিন।

যাহোক, একটি ভালো বই নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা বা প্রশংসা প্রকাশককে কিছুটা আর্থিক ক্ষতিও মেনে নিতে উৎসাহিত করে।

সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে দেশের আনাচে কানাচে বই পড়া আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পারলে অবশ্য সব দিক রক্ষা হয়। পাঠক বাড়বে, পাঠাগার বাড়বে,বই বিক্রি বাড়বে,লেখক-প্রকাশকদের কদরও বাড়বে। বাড়বে তরুণদের বইও।

পিয়াস মজিদ, তরুণ কবি

Piasবই প্রকাশে তরুণ লেখক বা লেখকের বয়স মূল বিষয় না। বিবেচ্য বিষয়টি হলো পান্ডুলিপির মান। তাই প্রকাশকদের সম্পাদনা পর্ষদ থাকা জরুরি। কারণ, পান্ডুলিপির মান যাচাই করবে সম্পাদনা পর্ষদ। সেখানে লেখক বয়সে তরুণ কিনা সেটা জানার প্রয়োজন নেই। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে অনেক প্রবীণ লেখকের বইও বিক্রি হয় না। সেটাকে তাহলে কী বলবেন? তাই মানটা জরুরি।

আর তরুণদের বই প্রকাশে সমস্যা হয় এই বিষয়ে কেউ কখনো জোরালোভাবে দাবিও তুলেনি। তার মানে লেখা ভালো হলে প্রকাশক বই প্রকাশ করেন। তবে ইদানিং দেখা যায় অনেক তরুণ লেখালিখির মাধ্যমগুলোতে না লিখেই বই প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাদের কাছে যে কোনভাবেই বই প্রকাশ করে মর্যাদার আসন লাভটাই বড়। কিন্তু এধরনের লেখকরা শেষ পর্যন্ত সাহিত্য থেকে ছিটকে যায়। তাই লেখালেখি করে যাওয়াটা জরুরি।

এখন তো অনেক মাধ্যম আছে। ব্লগ, ফেসবুক, সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি। তাই প্রতিটি মাধ্যমে যদি তরুণরা লেখালেখি তাহলে নামেরও একটা পরিচয় তৈরি হয়।

লীনা ফেরদোস, লেখক

Lina-Ferdousবই প্রকাশের সম্পূর্ণ বিষয়টি নির্ভর করে পাঠকের উপর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের দেশের অধিকাংশ পাঠকরা পরিচিত লেখকদের বইয়ের দিকেই আগ্রহ থাকে। অথচ আরো অনেক লেখক আছে যারা ভালো লিখছেন। পাঠকরা দরজা বন্ধ করে রাখেন। তাই দায়িত্বটা পাঠকদেরই নিতে হবে। তরুণদের লেখা পড়ে তাদের সম্পর্কে মতামত দেবে। এতে করে তরুণরা উৎসাহিত হবে। তাছাড়া এটাও ঠিক আমাদের দেশে পাঠক সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। পড়ার অভ্যাস কমে যাচ্ছে। পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এজন্য পরিবারের ভূমিকা থাকতে হবে। স্কুল কলেজগুলোতে বইপড়া কর্মসূচি নিয়মিতভাবে করতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে আবার পাঠকশ্রেণী বৃদ্ধি পাবে।

আবার তরুণদেরও উচিত সব মাধ্যমে লেখালেখি করা। লেখার চর্চা না করলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। অনেকেই আমাকে বলে, সব লেখা তো পত্রিকা প্রকাশ করতে চায় না। তখন আমি তাদের বলি, পত্রিকাই তো একমাত্র মাধ্যম না। পত্রিকা ছাড়াও ব্লগে লেখা যায়। ব্লগ তো এখন দ্বিতীয় গণমাধ্যম। সেই সঙ্গে শক্তিশালী মাধ্যম। সেখানে তরুণদের বেশি বেশি লিখে নিজের লেখাকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলা যায়। সেখান থেকে পাঠকও তৈরি হবে।

আমরা সবসময় প্রকাশকদের দোষ খোঁজার চেষ্টা করি। এটা ঠিক নয়। বইয়ের মান ভালো থাকলে বই প্রকাশে কোনও আপত্তি করা হয় না। তবে এখানে ব্যবসার বিষয়টি জড়িত। তাই নিয়মিত লেখালেখি করলে পাঠক থাকলে বই বিক্রিতেও সমস্যা হয় না। তাই তরুণদের বলবো, লিখে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।