শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট থেকে: ‘আত্মার কাছে দায়বদ্ধতায়, হাতে রাখি হাত’ এ স্লোগান নিয়ে ২০০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) যাত্রা শুরু করে কিন। দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ শুধু আমাদের জ্ঞানী করে তোলে না বা বাস্তব জীবনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার সনদই দেয় না, আমাদের মানুষ হিসেবেও গড়ে তোলে।
তানভীরের মতো একদল উচ্ছ¡ল, স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী মানবসেবার ব্রত নিয়ে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কিন’। প্রতিষ্ঠার পর সারা দেশে প্রশংসিত হতে থাকে তাদের কার্যক্রম। গত ৯ বছর ধরে সুবিধাবঞ্চিতদের বন্ধু হয়ে কাজ করে যাওয়ায় আলোর দিশারী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে কিন।
গত ২ ফেব্রæয়ারি সংগঠনের ৯ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচিতে নানা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আত্মার দায়বদ্ধতায় মানবতার জয়গান গেয়ে যাওয়ার শপথ করেন কিন’র সদস্যরা।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ক্যাম্পাসে আনন্দ র্যালি ও কেক কাটার আয়োজন করে কিন। আনন্দ র্যালিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন ‘এ’ এর সামনে থেকে শুরু হয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ শেষে অর্জুনতলায় এসে শেষ হয়। র্যালিতে সংগঠনটির বর্তমান ও সাবেক সদস্যরা ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কেক কাটেন সংগঠনটির উপদেষ্টা জায়েদা শারমীন স্বাতী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শাবির ছাত্র উপদেষ্টা ও নির্দেশনা পরিচালক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম এবং প্রক্টর হিমাদ্রি শেখর রায়। পরে সংগঠনটির প্রথম প্রকাশনা ‘আত্তি (আত্মার আকুতি)’ এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
ফিরে দেখা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই ভালো কাজের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ লক্ষ্যেই ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে অসহায়, নিপীড়িত এবং দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে জড়ো হন ওই শিক্ষার্থীরা। মানবসেবায় তাদের এই একত্রীকরণ আর ভালো কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে জন্ম হয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কিন’ এর। শুরু হয় পথচলা।
ছোট্ট পরিসরে জন্ম নেওয়া ওই সংগঠনটির পরিধি এখন অনেক বড়। অনেক যত্নে বোনা ছোট্ট গাছটি যেন আজ বটবৃক্ষ। এখন তার অনেক ডালপালা। এই গাছের ছায়ায়ই প্রাণ জুড়ান সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং অসহায়, নিপীড়িত এবং দুস্থ মানুষেরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদনের আগেই সংগঠনটি ‘আত্মার কাছে দায়বদ্ধতায় হাতে রাখি হাত’ স্লোগান নিয়ে শুরু করে তাদের কার্যক্রম। অসহায় শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিলেট শহরের বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়ান সংগঠনটির সদস্যরা। বস্তি, রেলস্টেশন এবং সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ এলাকায় শীতবস্ত্র বিতরণের মাধ্যমে শুরু হয় স্বপ্নযাত্রা।
কিনকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে প্রশাসনিক অনুমোদন পায় সংগঠনটি।
বিরামহীন পথচলা
সংগঠনটির একদল উচ্ছ¡ল, স্বাপ্নিক তরুণ-তরুণী সদস্যরা মানবসেবার ব্রত নিয়ে স্বার্থহীন মানসিকতার স্বপ্নকে ধারণ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করছেন, অসহায় রোগীদের স্বেচ্ছায় রক্তের যোগান দিচ্ছেন কিংবা অসুস্থ কাউকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনার সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এছাড়া জবুথবু শীতের কাঁপুনি থেকে রক্ষায় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এক টুকরো উষ্ণতা দেওয়ার জন্য হলে হলে ঘুরে শীতবস্ত্র সংগ্রহ করছেন, কখনো এসিড বিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছেন অথবা সিডর আইলার মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মুহূর্তে আর্তমানবতার সেবায় প্রসারিত করছেন তাদের সেবার হাত।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে
‘চেনা হোক প্রতি মুখ শিক্ষার আয়নায়’ এ স্লোগান নিয়ে এবং আলোকিত জাতি গঠনের লক্ষ্যে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশুদের জন্যে ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ কিন চালু করে একটি স্কুল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা ও অ্যাসাইনমেন্টের ফাঁকে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির পর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান করেন সংগঠনটির সদস্যরা। তাই প্রতিদিন এ সময়টায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠে ক্যাম্পাস।
পড়াশোনার পাশাপাশি এসব পথশিশুকে নিয়মিত চলচ্চিত্র ও কার্টুন দেখানো, স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, নাচ গান শেখানোসহ তাদেও নিয়ে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাও দেওয়া তাদের।
অসহায় শীতার্তদের পাশে
শীতের তীব্র কাঁপুনি থেকে বাঁচাতে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এক টুকরো উষ্ণতা দেওয়ার জন্য প্রতি বছরই শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে কিন সদস্যরা বিলিয়ে দিচ্ছেন দরিদ্রদের মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার আগেই শীতবস্ত্র সংগ্রহের মাধ্যমে শুরু হয় তাদের কার্যক্রম।
২০০৩ সালে প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পর মঙ্গাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে কিন সদস্যরা সংগ্রহ করেন নগদ টাকা ও শীতবস্ত্র। এরপর থেকে প্রতি বছরই আর্তমানবতার সেবায় শীতার্তদের সাহায্যার্থে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তারা। শীতবস্ত্র সংগ্রহের জন্য তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে গ্রহণ করেন বিভিন্ন পদক্ষেপ।
শীতবস্ত্রের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীদের হল ও মেসের পাশাপাশি সিলেট শহরের বিভিন্ন বাসায় বাসায়ও ঘুরে বেড়ান সংগঠনটির সদস্যরা।
সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৪ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার বাসিন্দাদের মাঝে উপজেলা পরিষদ অফিসে ১৫৫০টি শীতবস্ত্র, ৭৫টি কম্বল ও ১০টি শাল বিতরণ করেন তারা। এ সময় বানিয়াচং উপজেলা ত্রান বিতরণ বিষয়ক কর্মকর্তার কাছে ২৫টি কম্বল ও ২৫০টি শীতবস্ত্র হস্তান্তর করা হয়।
পরে ২৯ ডিসেম্বর পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার পাচশিরি, মির্জাপুর, রামেরডাঙ্গা, গড়েরডাঙ্গা ও যতনপুকুর গ্রামে গিয়ে ৮০০টি শীতবস্ত্র ও ৭৫টি কম্বল গ্রামবাসীদের মাঝে বিতরণ করা হয়। শেষ দিন ৩০ ডিসেম্বর গভীর রাতে সিলেট শহরের রেলওয়ে স্টেশন, কিন ব্রিজ ও শহরের ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকা শীতার্ত ও বাস্তুহারা মানুষের মাঝে আরো ২৫০টি শীতবস্ত্র বিতরণ করেন কিন সদস্যরা।
স্বেচ্ছায় রক্তের যোগান
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবাইকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করে যাচ্ছে সংগঠনটি। যদি কোনো ব্যক্তির জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন হয় তাহলে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সংগঠনের সদস্যরা যে কোনো মুহূর্তে রক্ত দিতে প্রস্তুত।
অনেক অসহায় দরিদ্র মানুষ আছেন, যারা টাকার বিনিময়ে রক্ত কিনতে পারেন না। রক্তের অভাবে নিভে যায় যাদের জীবন প্রদীপ। তাদের পাশে দাঁড়াতেই সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের রক্তদানমূলক সংগঠন ‘সন্ধানী’র সহযোগিতায় প্রতি চার মাস পরপর স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কিন’। একই দিনে রক্ত সংগ্রহের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা এবং বিনামূল্যে ওষুধও প্রদান করা হয়।
২০০৪ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হয় তাদের এ কার্যক্রম।
মানবতার ডাকে সাড়া
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সুমন, কাজী লিটন, শান্তি, আসিফ ও সঞ্জীব। একজন আদর্শ মানুষ হয়ে সুন্দর দেশ গড়ার কারিগর হবেন, বাবা-মায়ের এ স্বপ্নের বাস্তবায়নে তারা ভর্তি হন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার মোক্ষম সময়ে মুত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়ান তারা। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এবং তাদেরকে প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত এসব মেধাবী ছাত্রদের বাঁচাতে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদশর্নীর আয়োজন করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিন।
আসমা ও ইমরানের চিকিৎসার্থেও তারা আয়োজন করে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর। এছাড়া সিলেট শহরের এক দরিদ্র পরিবারের ছেলে ইফাদের চোখের চিকিৎসার্থে পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়।
এসিডবিরোধী কার্যক্রম
২০০৪ সালের মার্চে সিলেটের গোয়াইনঘাটে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন দুই বোন খালেদা ও তাহেরা। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। এসিড সন্ত্রাস রুখতে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করে যাচ্ছে তারা।
সার্বিক বিষয়ে সংগঠনটির সভাপতি আফতাবুল আলম এলমান জানান, আর্তমানবতার সেবায় আত্মার আহ্বানে কাজ করে যাচ্ছে কিন। পরবর্তী প্রজন্মও কিন’র মাধ্যমে আত্মার দায়বদ্ধতা থেকে সমাজের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে কাজ করে যাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সালেহ উদ্দিন জানান, পড়াশুনার পাশাপাশি সমাজের অসহায় মানুষের জন্য কিনের কার্যক্রম প্রশংসার দাবিদার। তাদের এ কাজ সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ায় কিন’র সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি। আর এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন উপাচার্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১২