যশোর: শাহনাজ পারভীন এবার উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা দেবেন। এসএসসিতে এ মাইনাস।
এটি অসাধারণ কোনো বিষয় নয়, তার শ্রেষ্ঠত্ব অন্যখানে। লেখাপড়া, জামাকাপড় বা হাত-খরচের টাকার জন্য বাবার উপর নির্ভরশীল নন এই তরুণী। কীভাবে আসে তার সেসব খরচ-তা জানা গেলো তার মা-ভাইসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপে।
যশোর সদর উপজেলা ইছালী ইউনিয়নের একটি গ্রাম কামারগন্যা। ক্ষুদ্রচাষী ইমান আলীর দু’ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় শাহনাজ। চোখেমুখে তার আত্মপ্রত্যয়ের চিহ্ন।
দ্বিতীয় শ্রেণীতে যখন পড়েন, তখন মা হামিদা বেগমের সহায়তায় কাপড়ে সেলাই করে ফুল তোলায় হাতেখড়ি তার। প্রথম জীবনে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দু’টাকা উপার্জন।
রুমাল, কুশনকভার, সাইডব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনের থলে-কোথায় তোলেননি সুঁইয়ের আঁচড়ে নকশি ফুল! এখন শাহনাজ আরও পরিপক্ক! শাড়ি, নকশীকাঁথা, বেডকভার, চাদর-সবখানে অবাধ বিচরণ তার।
বাংলানিউজকে শাহনাজ জানান, ১৫ দিন থেকে একমাস সময়ের মধ্যে তিনি সেলাই করতে পারেন একটি শাড়ি, মায়ের সহায়তায় একখানি নকশীকাঁথাও- আত্মপ্রত্যয়ী শাহনাজ জানান।
এসব কাজের জন্য প্রতিটি কাঁথা থেকে দু’হাজারের মত টাকা পান। শাড়িভেদে আসে পাঁচশ’ থেকে দু’হাজার। বেডশিটেও পাওয়া যায় ভাল অঙ্কের টাকা। সহায়তা পেলে ভবিষ্যতে নিজেই ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা আছে তার।
শাহনাজের মা হামিদা বেগম বাংলানিউজকে জানান, স্বামী ইমান আলীর ক্ষেতখামার থেকে উপার্জিত টাকায় বছরের ৮মাসও ঠিকমতো চলে না।
তিনি নিজেও সেলাই করেন, সঙ্গে মেয়েও। তাদের দুজনের আয়ে সংসারের খরচ যেমন চলে, তেমনি মেয়ের লেখাপড়াও। বলা দরকার, বাড়ির সব কাজ সেরে তারপর চলে সেলাইয়ের কাজ।
তাদের মত কামারগন্যা গ্রামের আরও কয়েকটি পরিবারের কথা জানা যায়। ৫০ থেকে ৬০টি ঘরে চলছে এমন সেলাইয়ের কাজ। কামারগন্যা গ্রামে যারা সেলাইয়ের কাজ করছেন-তারা সরাসরি বিপণনের সঙ্গে জড়িত নন।
তাদের কাজের ফরমায়েশ আসে শহর বা শহরতলী থেকে। ক্রেতা বা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ডিজাইন, কাপড় আর সূতা সরবরাহ করা হয়। মাঠপর্যায়ের এসব শিল্পীই পৌঁছে দেন সেসব পণ্য।
এমন বেশ কয়েকটি হাউজ রয়েছে যশোর শহরতলীতে। যাদের বলা হয়ে থাকে ক্ষুদ্রউদ্যোক্তা।
শহরতলী কিসমত নওয়াপাড়া এলাকায় ছোট্টপরিসরে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম তাসলিমা এন্টারপ্রাইজ। তাসলিমা বেগম যার পরিচালক। প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি এসব হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িত। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তার প্রতিষ্ঠানের পণ্য নিয়ে শামিল হয়েছেন মেলায়। স্বামী আব্দুল হাইয়ের সহায়তায় চালিয়ে যাচ্ছেন এই ব্যবসা। কথা হয় তাসলিমা বেগমের সঙ্গে।
তিনি জানান, শাহজালাল ব্যাংক থেকে সম্প্রতি এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু, এখন যে বাজার তাতে এই টাকা খুবই সামান্য।
তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন উপশহরে অবস্থিত হাসান হস্তশিল্পের উদ্যোক্তা ফাতেমা জহুরা। বাড়িতেই রয়েছে তার ৭জন কর্মী, সেলাই মেশিন ৯টি।
তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে লাখ পাঁচেক টাকা পাওয়া গেলে সুবিধা হতো। এখন কাপড়, সুতোর দাম যেমন বেড়েছে তেমনি মজুরিও বেড়েছে।
তাসলিমা, জহুরা, সাইদুন নাহার, মর্জিনা, বীনা বেগমের মতো অনেক নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন এসব এলাকায়। যাদের অল্পবিস্তর ঋণ সহায়তা করছে বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংক।
এ বিষয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ব্যবস্থাপক ও ভাইস প্রেসিডেন্ট সাঈদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, গত বছরের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড.আতিউর রহমান ১০ নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মাঝে ঋণ দিয়ে আমাদের এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। ৫০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা দেয়া হয় ঋণ হিসাবে। এই খাতে গ্রণগ্রহীতার সংখ্যা বর্তমানে ৮০ জন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা যদি সফলতার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন, তবে ঋণের অঙ্ক আরও বাড়ানোর ইচ্ছা প্রতিষ্ঠানের আছে। খুব শিগগির নতুন করে এ খাতে আরও ২৫ জনের মধ্যে ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১২