ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

আমির হোসেনের অধরা স্বপ্নগুলো

টি.এম. মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:০৪, মার্চ ৩, ২০১২
আমির হোসেনের অধরা স্বপ্নগুলো

বগুড়া: ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা ব্যক্তিগত গাড়িটি যদি সহসা উড়োজাহাজের মতো আকাশে উড়ে যেতো! আবার ইচ্ছেমতো সেটিকে নামিয়ে আনা যেতো কোনো ফাকা রাস্তায়!

নাগরিক জীবনের যাতনায় বিরক্ত অনেকের মনেই এমন স্বপ্ন উকি দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবেন- এটা কী করে সম্ভব! কিন্তু বগুড়ার আমির হোসেনের কাছে এটি স্বপ্ন নয়; নিরেট বাস্তব।

তবে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তার সৃষ্টিশীলতার পুরোপুরি বিকাশ ঘটছে না।

আমির হোসেন। বগুড়ার মানুষের কাছে তিনি ‘গাড়ি বানানোর বিজ্ঞানী’ হিসেবে পরিচিত। প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। বাড়ি শহরের কাটনার পাড়া এলাকায়।

তার বাবা ধলু মেকার ১৯৪০ সালের মাঝামাঝিতে গড়ে তোলেন বগুড়ার প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ। বাবার পরিচিতিটাকে অনেক ঊচ্চতায় নিয়ে গেছেন আমির। ১৯৮১ সালে বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ালেখা সম্পন্ন করেন।

গাড়ি তৈরির পর তাকে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। যেকারণে অধিকংাশ সময় মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়না তাকে। অনেক কষ্টে ফোনে যোগাযোগ করার পর বগুড়া সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী ধরমপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো আমির হোসেনের গাড়ি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা।

আমির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, ৮ ভাইবোনের সংসারে তার অবস্থান ৫ নম্বরে। ছেলেবেলায় পড়াশুনা করার সময় বাবার নির্দেশে প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা সময় তাদের ওয়ার্কসপে বসতে হতো। তাই ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছঅত্র থাকতেই তিনি ঝুঁকে পড়েন যন্ত্রাংশ তৈরির দিকে।

গানপ্রিয় এই ব্যক্তিই গবেষণা ও সৃষ্টিশীলতায় পরে বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিতি পান। বিদ্যালয়ে পরাবস্থাতেই ১৯৭৮ সালে তৈরি করেন জাপানি শ্যালো মেশিনের লয়নার পিস্টন। যা বাংলাদেশের প্রথম। সে সময় জাপানের তৈরি যে লায়নার পিস্টন বাজারে বিক্রি হতো ৩ হাজার টাকায়। সেই লায়নার পিস্টনটি তিনি মাত্র ৪০০ টাকা খরচ করে তৈরি করতেন।

শুরু হলো ক্ষুদে এই বিজ্ঞানীর পথ চলা। এরপর ডিশ অ্যান্টিনা, চিক সেমাই তৈরির মেশিন, ইটভাঙা মেশিন ইত্যাদি তৈরি করেন। তখন বিদেশের তৈরি ইটভাঙ্গা মেশিন বিক্রি হতো হতো প্রায় ১ কোটি টাকায়। যা আমির হোসেনের গবেষণায় মাত্র ৫০ হাজার টাকায় সম্ভব হয়ে ওঠে।
 
এভাবেই ভাবনার আবর্তে একদিন গাড়ি তৈরির নেশা তাকে পেয়ে বসে। শুরু হয় গবেষণা। এক পর্যায়ে ২০০৮ সালের মাঝামাঝিতে প্রথম ইলেকট্রনিক্স টারবাইন সিস্টেম জিপ তৈরি করে নজর কাড়েন দেশবাসীর।

এরপর ২০১০ সালে প্রায় একই আদলে ২ টি পৃথক মডেলে তৈরি করেন সিএনজি ও বায়োগ্যাসচালিত জিপ।

২০১১ সালের মাঝামাঝিতে তিনি প্রাকৃতিক বাতাসের উপর বিষদ গবেষণা করে তৈরি করেন জ্বালানিবিহীন জিপ। যার একটি চলবে শুধু সড়ক পথে। আরেকটি একই সঙ্গে আকাশ ও সড়ক উভয়পথে চলবে।  

২০১১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে রাজধানী ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তন থেকে আন্তর্জাতিক কৃষি পদক লাভ করেন আমির হোসেন। সেখানে তার আবিস্কৃত ধানকাটা মেশিন, জমি নিড়ানি, বীজ বপণ, জৈব সার, গুটি সার, ধান মাড়াই, ভূট্টা মাড়াই, আলু গ্রেডিং মেশিনসহ বেশকিছু কৃষি যন্ত্রাংশ স্থান পায়।

তিনি জানান, ২০০৬ সালে যখন গুটি ইউরিয়া সার তৈরির মেশিন বিক্রি হয়েছে ৪ লাখ টাকায়, তখন তার আবিস্কৃত  একই মেশিন তৈরি করতে খরচ হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা।

ইলেকট্রন্ক্সি টারবাইন সিস্টেম গাড়ি

এই গাড়ি চালাতে প্রয়োজন ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারি। অটোমনিটরে লো ভোল্টেজ প্রবেশ করে গাড়ি চলার সময় হাই ভোল্টেজ তৈরি হয়ে যায়। আর এই প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করে  ব্যাটারিকে সচল রাখার জন্য কাজ করে কার্বন নামের ছোট্ট একটি যন্ত্রাংশ।

প্রতি ৮ ঘণ্টা পরপর এই কার্বনটি কিনতে খরচ হবে বর্তমান বাজার মূল্যে সর্বোচ্চ ২৫ টাকা। গাড়ি তৈরিতে খরচ হবে দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা। প্রয়োজনীয় সুবিধা পেলে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৫০ টি গাড়ি তৈরি করা সম্ভব বলে জানান আমির হোসেন।

ইয়ার টারবাইন সিষ্টেম গাড়ি

প্রাকৃতিক বাতাসকে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে রিজার্ভ ট্যাংকিতে ভরে ২৫টি পেনিয়ামের মাধ্যমে টারবাইন তৈরি করে শক্তিশালী এই গাড়ি চলাচল করে। দুই ধরনের ইয়ার টারবাইন গাড়ি আবিস্কার করেছেন আমির। একটি চলবে শুধু সড়ক পথে। অন্যটি সড়ক ও আকাশ উভয় পথেই চলবে।

শুধু তাই নয়, যেখানে প্রয়োজন সেখানেই স্বল্প জায়গায় তাৎক্ষণিকভাবে উড়াল দিয়ে ১৪০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার বেগে সবদিকে ঘুরানোর ক্ষমতা নিয়ে চলবে ৪ সিলিন্ডার সম্পন্ন এবং ৮ টি রিজার্ভ ট্যাংকির এই উড়াল গাড়ি। আকাশ পথে একটানা ৫০০ কিলোমিটার চলতে পারবে এই গাড়ি।

তিনি জানান, একইভাবে হাইড্রোলিক প্রেসারের মাধ্যমে যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে নামতেই উড়াল গাড়ির পাখাটি আগের মতো সংকোচিত হয়ে আসবে। এক্ষেত্রে একই সঙ্গে আকাশ ও সড়ক পথে চলার গাড়িটি তৈরি করতে করতে খরচ হবে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকা।

শুধু সড়ক পথে চলার গাড়িটির গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। যা তৈরি করতে খরচ হবে মাত্র ২ লাখ টাকা। বিজ্ঞানী আমির হোসেন তার আবিস্কৃত বাতাস দিয়ে চালিত গাড়িটির নির্মাণ কৌশল বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, জ্বালানি হিসেবে বাতাস নির্ভর  গাড়িটি ৫ আসন বিশিষ্ট। গাড়ির বডি নির্মিত হচ্ছে হাওয়াই অ্যালাই দিয়ে। এর ওজন মাত্র ৩০০ কেজি।

অন্যান্য গাড়িতে জ্বালানি তেল সংরক্ষণের জন্য যেমন ট্যাংক থাকে, এটিতেও তেমনি থাকবে। তবে ট্যাংক শুধু প্রাকৃতিক ঘণীভূত বাতাসে ভরা থাকবে। কমপ্রেসারের মাধ্যমে এই ট্যাংকে প্রাকৃতিক বাতাস ভরতে সময় লাগবে ৮ মিনিট।

প্রতি চার ঘণ্টা পর পর গাড়িটিতে কমপ্রেসারের মাধ্যমে বিকল্প পথে একটি ফুয়েল বার্নার ঘণীভূত বাতাস গরম করার মাধ্যমে বাতাসের চাপ বাড়িয়ে দেবে। এভাবে গাড়ির গতি বাড়বে। শুধু ২৪টি পেনিয়াম দ্বারা তৈরী ইঞ্জিন যা চলবে শুধু ইয়ার টারবাইন দিয়ে।

বায়োগ্যাস বা সিএনজি চালিত গাড়ি

এই গাড়িটি চলবে সম্পূর্ণ বায়োগ্যাস অথবা সিএনজি গ্যাস দিয়ে। জ্বালানি খরচ একেবারে কম বললেই চলে। ১৫০ কিলোমিটার পথ চলতে খরচ হবে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। প্রস্তুত কারক আমির হোসেনর যুক্তি- স্বাভাবিক সাইজের ১৫ টি গরু বা মহিষের বর্জ দিয়ে প্রতিদিন ২০ টি সিলিন্ডার ভর সম্ভব। সেক্ষেত্রে একটি ৫০ কেজি ওজনের সিলিন্ডারে কমপক্ষে ১৫০ কিলোমটিার পথ চলতে পারবে এই গাড়ি। বিশেষ কোনো অসুবিধা না হলে প্রতিমাসে এধরনের ২০টি গাড়ি তৈরি করা সম্ভব।  

আমির হোসেনের মেধার খোঁজ পেয়ে ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি দল তার কারখানা পরিদর্শন করেছে।
 
আমির হোসেনের প্রযুক্তি নিয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অত্যাধুনিক কারখানা তৈরি করতে চেয়েছে ভারতীয় টিভিএস, সুইজারল্যান্ড, ইটালি ও সৌদি আরবের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

তার কিছু দুঃখ

তিনি কয়েক দফায় শিল্প মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে সুদমুক্ত ঋর চাইলে সরাসরি তাকে নাকচ করে দেওয়া হয়। ফলে তার উদ্যোগ বেশিদূর এগুতে পারেনি।

সরকারের কাছে চাওয়া

আমির হোসেনের বিশ্বাস, সরকার সুদমুক্ত ঋণ দিলে তিনি মাত্র ৩ বছরের মধ্যে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে নতুন করে তুলে ধরতে পারবেন। এছাড়া ঋণ পাওয়া গেলে তার কারখানায় শত শত শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। এতে বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলের মানুষ বিদেশে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেবে।

বাংলাদশ সময়: ২০২৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।