কমনওয়েলথ সমাধি ক্ষেত্র অথবা ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। স্থানীয় লোকদের কাছে এটা ইংরেজদের কবরস্থান হিসেবে পরিচিত।
এরমধ্যে ২৪ জন জাপানি যুদ্ধ বন্দি এবং ১ জন বেসামরিক ব্যক্তি। স্থানীয়দের ভাষায় একে ইংরেজ কবরস্থান বলা হলেও আসলে এখানে সারিবদ্ধভাবে শায়িত রয়েছেন মুসলিম, খৃষ্টান, ইহুদী, হিন্দু এবং বৌদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত এবং যুদ্ধে আহত হয়ে পরে মারা যাওয়া সাধারণ সৈনিক থেকে ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার এখানে সমাহিত করা হয়েছে।
কুমিল্লা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের টিপরা বাজার। টিপরা বাজার ও ময়নামতি সাহেবের বাজারের মাঝামাঝি কুমিল্লা-সিলেট সড়কের বাম পাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাড়ে চার একর পাহাড়ি ভূমি জুড়ে বাংলাদেশে অবস্থিত দ্বিতীয় এ কমনওয়েলথ সমাধি ক্ষেত্র। দেশে অপর কমনওয়েলথ সৈন্যদের সমাধি রয়েছে চট্টগ্রাম শহরের বাদশা মিয়া চৌধুরী রোডে। সেখানে ৭৫৫ সৈনিকের সমাধি আছে।
কুমিল্লা কমনওয়েলথ সমাধির পাহাড়ের প্রথম ধাপে রয়েছে ইউরোপিয়ানদের কবর। উপরের ধাপে রয়েছে এ উপমহাদেশের যোদ্ধাদের কবর। সমাধিগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে। ১৪টি বাদে প্রত্যেক সমাধিতে লেখা আছে নিহত সৈনিকের নাম, বয়স, পদবী, নিহত হবার তারিখ ও ঠিকানা।
সমাধিক্ষেত্রের আগে সেখানে ছিল বৌদ্ধ বিহার মন্দির। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে শ্বেত পাথরের একটি ক্রশ। বর্গাকার এ সমাধি ক্ষেত্রের প্রত্যেকটির দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াইশ ফুট। সমাধি ক্ষেত্রের মোট আয়তন সাড়ে ৪ একর। সমাধি ক্ষেত্রের চারদিক বাউন্ডারি দেওয়া।
পুরো সমাধিক্ষেত্রে হরেক রকম ফুল এবং অন্যান্য গাছ দিয়ে পরিকল্পিত ও সুবিন্যস্তভাবে সাজানো। গাছ-গাছালির অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘিরে রেখেছে এ সমাধিক্ষেত্রটি। এ সমাধি ক্ষেত্রটিতে গেলে ফুলের সৌরভ, গাছের পাতায় বাতাস আর রোদের খেলা, পাখীর ডাকে বিমোহিত পরিবেশ সৃষ্টি করে মনে অন্যরকম এক অনুভূতি জাগায়। তখন মনে হয় মানব জাতির জন্য যুদ্ধ কি খুব প্রয়োজনীয়?
এখানে সমাধির সংখ্যা ছিল ৭৩৮টি। ১৯৬২ সালে এ সমাধিস্থল থেকে একজন সৈনিকের আত্মীয়স্বজন তার দেহাবশেষ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। বর্তমানে এ সমাধি সংখ্যা ৭৩৭টি। এরমধ্যে ১৪জন সৈনিকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এখানে যাদের সমাহিত করা হয়েছে তাদের লাশ আনা হয়েছে ঢাকা, ফরিদপুর, সৈয়দপুর ও সিরাজগঞ্জ থেকে। আর্মি গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারগণ এ সমাধি ক্ষেত্রটি তৈরী করেন।
এ সমাধি ক্ষেত্রে রয়েছে- বৃটেনের ৩৫০ জন, কানাডার ১২ জন, অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন, নিউজিল্যান্ডের ৪ জন, দক্ষিণ আফ্রিকার ১ জন, ভারতের ১৭২ জন, পূর্ব আাফ্রিকার ৫৬ জন, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ জন, বার্মার ১ জন, দক্ষিণ রোডেশিয়ার ৩ জন, বেলজিয়ামের ১ জন, পোলান্ডের ১ জন এবং জাপানের ২৪ জনের কবর।
এ ছাড়াও ১জন বেসামরিক ব্যক্তিকেও এখানে সমাহিত করা হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে লাশ এনে এখানে সমাহিত করা হয়। কুমিল্লার ময়নামতি এবং চট্টগ্রামের সমাধিক্ষেত্র দু’টির সার্বিক তদারকি করছে কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশন। এর প্রধান কার্যালয় লন্ডনে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের অনুদানে চলে এ সংস্থাটি।
এ কমিশন বাংলাদেশের এ দু’টি সমাধিক্ষেত্র ছাড়াও ভারতের ১০টি, বার্মার ৩টি, পাকিস্তানের ২টি, থাইল্যান্ডের ২টি, সিঙ্গাপুরের ১টি, মালয়েশিয়ার ১টি, এবং জাপানের ১টি সমাধিক্ষেত্র রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
কুমিলল্লার ময়নামতি সমাধিক্ষেত্রটিতে গ্রেভস কমিশনের নিয়োগকৃত ১জন কেয়ারটেকার ও ৫ জন গার্ডেনার রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত।
ঈদের দু’দিন ছাড়া বছরের প্রতিদিনই সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ সমাধিস্থল সর্ব সাধারণের জন্য উম্মুক্ত।
এ সমাধিক্ষেত্রে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের শত শত দর্শনার্থী আসেন। দেখে অনুভব করেন- যুদ্ধ শুধু জ্বালায়-পোড়ায় না, যুদ্ধ অকালে নিভিয়ে দেয় অনেক জীবন প্রদীপও।
jashimcomilla2011@gmail.com
বাংলাদেশ সময় : ১২৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০১২