খুলনা : উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমি ও বনভূমিতে জোরপূর্বক নোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়িচাষ নিষিদ্ধ হলেও তা মানছেন না রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, দোষীদের বিরুদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ড মামলা করলেও পুলিশ আসামিদের না ধরায় নতুন করে মামলা দায়েরের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না পানি উন্নয়ন বোর্ড।
খুলনার দাকোপ উপজেলার কামারখোলা গ্রামের বাসিন্দা দেবাশীষ রায় বাংলানিউজকে জানান, কয়েক বছর আগে প্রভাবশালীরা স্থানীয় পোল্ডার এলাকায় বাঁধ কেটে লোনা পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়িচাষ করায় ধানসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিন্তু আইলার পর প্রতিনিয়ত বিলে পানি প্রবেশ করায় চিংড়িচাষ বন্ধ ছিল। ইতোমধ্যে ভেঙে যাওয়া বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়েছে। একশ্রেণীর চিংড়িচাষিরা বাঁধের মধ্যে আবারও লোনা পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়িচাষের চেষ্টা করছেন। এতে বাঁধ ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
দেবাশীষের মতো এখানকার অসংখ্য কৃষকের অভিযোগ, তারা ফসলি জমি চিংড়িচাষের জন্য লিজ দিতে অস্বীকৃতি জানালেও জোর করেই তাদের জমিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় লবণাক্ত পানি। থানা পুলিশে জানালেও কোনো কাজ হয় না। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় সামাজিকভাবেও কোনো বিচার পান না ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আ. আজিজ এ ধরনের অপতৎপরতার কথা স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, ঘুর্ণিঝড় সিডর-আইলার পর এ অঞ্চলে লবণাক্ত পানি ঢুকে কৃষি আবাদ দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়। পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টির পানিতে লবণাক্ততা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে বর্তমানে জমিগুলো আবাদের উপযোগী হয়েছে। অনেক জমিতে ফসলের উৎপাদনও বেড়েছে। কিন্তু নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি করছেন একশ্রেণীর প্রভাবশালী চিংড়িচাষিরা। তারা জোর করে কৃষকের জমিতে লবণাক্ত পানি ঢোকাচ্ছেন। ফলে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে কোনো ফসল হচ্ছে না। এমনকি আশপাশের গাছপালা ও প্রাণিবৈচিত্র্যও মারা যাচ্ছে।
তিনি জানান, প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়িচাষ করায় বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর ফসলি জমিতে কোনো আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। একাধিক সরকারি সভায় এ বিষয়টি তুলে ধরে সমস্যা সমাধানের দাবি জানানো হলেও অপরাধীরা প্রভাবশালী হওয়ায় কিছু করা সম্ভব হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
পাউবো’র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, লোনা পানিতে চিংড়ি চাষকারী ঘের মালিকেরা হাইকোর্টের নির্দেশও মানতে চান না। হাইকোর্ট ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী বেড়িবাঁধ কেটে পোল্ডার এলাকায় লোনা পানি প্রবেশ না করানোব জন্যে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। সে নোটিশ অনেকেই অগ্রাহ্য করেছেন। যারা নিষেধাজ্ঞা মানেননি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় যারা বেআইনিভাবে বেড়িবাঁধ কেটে পাইপ বসিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মামলার সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। অথচ বেআইনিভাবে বাঁধ কাটা চিংড়ি ঘের মালিকরা ওই মামলাকে হয়রানিমূলক মামলা বলে দাবি করেন।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ‘নিজেরা করি’ দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে জোর করে লোনা পানি তুলে চিংড়িচাষ বন্ধে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। ওই দিন হাইকোর্ট রুল জারি করেন। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি লোনা পানি তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বুধবার আদালত ‘উপকূলীয় কৃষিজমি-বনভূমিতে লোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ অবৈধ’ রায় দেন। ’
কৃষির বর্তমান অবস্থা
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চিংড়িচাষ শুরুর আগে খুলনার গ্রামীণ জনপদ কৃষিনির্ভর ছিল। বর্তমানে ঘের কিংবা ঘেরের বাইরের বহু এলাকায় ধানচাষে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন কৃষকরা, কিন্তু কিছু প্রভাবশালী ঘের মালিকরা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন ফসল আবাদে। চলতি মৌসুমে খুলনায় বোরো আবাদ করা হচ্ছে প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে। গত বছর আবাদ হয়েছিল ৪৯ হাজার হেক্টর (প্রায়) জমিতে।
শোভনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার আব্দুল গণি দাবি করেন, শোভনা ইউনিয়ন এক সময় সবজির জন্য বিখ্যাত ছিল। গত কয়েক বছর আগে বেশিরভাগ জমিতে নোনা পানি আটকে থাকতো। কিন্তু ৫/৭ বছর আগের সেই নোনার অবস্থা অনেকটা কমেছে। ফলে কৃষকরা আবারও চাষাবাদে মনযোগী হচ্ছেন।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মহাদেব চন্দ্র সানা জানান, উপজেলার মধ্যে শোভনা, আটলিয়া, খনির্য়ায় বেশি সবজির আবাদ হয়। চলতি রবি মৌসুমে ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে।
তিনি জানান, চাষিরা এবার ভালো ফলন পাবেন। খুলনা জেলার প্রায় ৬০ শতাংশ সবজি উৎপন্ন হয় শুধু ডুমুরিয়াতেই। উপজেলায় প্রায় আড়াই শত কোটি টাকার সবজির আবাদ হয়।
চিংড়িচাষের মূল সঙ্কট
বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিংড়িচাষ ও রফতানি শুরু হয় আশির দশকে। এর পর থেকে বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় লোনা পানিতে বাগদা চিংড়ি এবং মিষ্টি পানিতে গলদা চিংড়ির চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। গড়ে ওঠে বহু হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। এখানকার উৎপাদিত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ করে তা হিমায়িত খাদ্য পণ্য হিসেবে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি শুরু হয়। খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে চিংড়িচাষ।
কিন্তু শুরু থেকেই বিজ্ঞান ভিত্তিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ না করায় অচিরেই হোচট খায় চিংড়িচাষের অগ্রযাত্রা।
ওয়ার্ল্ড ফিস সেন্টার বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. কুদরুত ই কবির বাংলানিউজকে জানান, দেশে বর্তমানে বাগদা পোনা উৎপাদনের জন্য ৬০টি হ্যাচারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে যে পরিমাণ পোনা উৎপাদিত হয় তা আমাদের দেশের মোট চিংড়ি ঘেরের পোনার চাহিদার তিনগুণ। চাষিরা না বুঝে ঘেরের আয়তন অনুপাতে বেশি পোনা মজুদ করেন। ফলে চিংড়ি রোগাক্রান্ত হয় ও ভালো ফলন হয় না।
তিনি জানান, প্রতি ১ হেক্টর আয়তনের জলাভূমিতে ১০ হাজার পোনা দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। কিন্তু চাষিরা এর দ্বিগুণ পোনা দেন। এ কারণে ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগে চিংড়ি মারা যায়। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে চিংড়িচাষের বিষয়ে বর্তমানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
খুলনা মৎস্য সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রফতানি বাণিজ্যে চিংড়ি গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হলেও ঘেরে ভাইরাসের সংক্রমণসহ নানা কারণে বার বার চিংড়িচাষ ও উৎপাদন ব্যাহত হয়। ওজন বৃদ্ধি করার জন্য চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য পুশ করাসহ বিভিন্ন কারণে চিংড়ি খাত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, খুলনা জেলায় বাগদা চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা ২৩ হাজার ৭২০টি ও আয়তন ৩৬ হাজার ৪২৭ দশমিক ৫২ হেক্টর। ২০১১ সালে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৪৫৬ দশমিক ৭৭ মেট্রিক টন। গলদা চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৬৮০টি, যার আয়তন ১৪ হাজার ১২১ দশমিক ৩৮ হেক্টর। ২০১১ সালে গলদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ৬৪৮ দশমিক ৮১ মেট্রিক টন।
‘চিংড়ি চাষ ও ফসল আবাদ দু’টিই আমাদের অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন। একটির জন্য অন্যটি বন্ধ করে দেওয়া সমাধান নয়। তাই এর জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। চিংড়ি চাষ ও ধান বা অন্য কৃষি আবাদের জন্য পৃথক জোন তৈরিও জরুরি। ’ বিশেষজ্ঞরা চলমান এ সঙ্কট উত্তরণে জানিয়েছেন এসব সুপারিশের কথা ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট’র খুলনার পাইকগাছা লোনাপানি কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) ড. শ্যামলেন্দু বিকাশ সাহা বাংলানিউজকে বলেন, ‘চিংড়িচাষে চলমান সঙ্কট লাঘবে আমাদের ইনস্টিটিউট বেশকিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তি চাষিদের মাঝে সম্প্রসারিত করা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। ’
তিনি আরো বলেন, চিংড়ি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ পদ্ধতি। যারা এটি বুঝে করছেন, তারা ভালো ফলন পাচ্ছেন। যারা না বুঝে করছেন, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ড. সাহা মনে করেন, চিংড়ি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। গত বছরেও এ শিল্পের মাধ্যমে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে। কৃষির সঙ্গে একে সাংঘর্ষিক না করে চিংড়িচাষ ও কৃষি আবাদের জন্য পৃথক এলাকা নির্দিষ্ট করা জরুরি।
বাংলাদেশ সময় : ১৯৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০১২