ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

আমি সাংবাদিক, নারী সাংবাদিক নই

শাহনাজ মুন্নী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:৩৩, মার্চ ৭, ২০১২
আমি সাংবাদিক, নারী সাংবাদিক নই

সাংবাদিকতায় নারীরা আছেন এটা এখন দৃশ্যমান সত্য। অনেকেই খুব আশার সঙ্গে বলেন, মেয়েরা সাংবাদিকতায় বেশ ভালো করছে।

বিপুল সংখ্যক মেয়ে সাংবাদিকতায় আসছে। কথাগুলো আদর করে শিশুদের পিঠ চাপড়ে দেওয়ার মতো সত্য। তবে এর পাশাপাশি এও সত্য যে অনেক আগে থেকেই অল্পসংখ্যক নারী সাংবাদিক, সংবাদপত্র বা প্রিন্ট মিডিয়ার ডেস্কে তো বটেই, রিপোর্টিং-এও কিছু কিছু কাজ করছিলেন। তবে জনসাধারণের চোখে তাদের দৃশ্যমানতা সম্ভবত প্রথম স্পষ্ট হয় টেলিভিশন সাংবাদিকতা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে। তখনই লোকজন প্রথম সনাক্ত করতে পারে সাংবাদিকতার মতো ‘পুরুষালী’ কিংবা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ পেশায় মেয়েরা আসছেন এবং মাঠপর্যায়ে ‘পুরুষের মতোই’ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন। সেই দৃশ্যমানতার পর প্রায় দশ বারো বছর পেরিয়ে গেছে, অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন নতুন টেলিভিশন চ্যানেল এসেছে, আসছে, বলা চলে, মেয়েদের জন্য সাংবাদিকতার ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েছে, অন্তত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তো হয়েছেই, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো সাংবাদিকতায় নারী পুরুষের অনুপাত সমান নয়, বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৫ ভাগ নারী; আর যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নারীদের জয়-জয়াকার নিয়ে বেশ হৈ চৈ সেই টেলিভিশন চ্যানেলের অধিকাংশ নিউজরুমেই ১০০ জন সাংবাদিকের মধ্যে ৭৫ জন সাংবাদিক পুরুষ হলে মাত্র ২৫ জন সাংবাদিক থাকেন নারী। অর্থাৎ তিন ভাগের মাত্র একভাগ নারী। আবার কোথাও কোথাও এই অনুপাত  আরো কম। হয়তো তিন ভাগের মধ্যে আড়াইভাগ কিংবা পৌনে তিনভাগই থাকেন পুরুষ সাংবাদিক।

বছরখানেক  আগে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ জার্নালিজম করা আমেরিকান জার্ণালিষ্ট সার্ভের রিপোর্টে বলা হয়েছে, খোদ আমেরিকাতেও নাকি ওভার অল নারী সাংবাদিকের সংখ্যা বাড়েনি এবং সেখানেও নাকি মূল ধারার সাংবাদিকতায় ফুল টাইম নারী সাংবাদিক সেই তিনভাগের একভাগই। অবশ্য এটা ভেবে আমাদের খানিকটা নিশ্চিন্ত  হয়ে বগল বাজাবার কিংবা হাত-পা ছেড়ে বসে থাকার কিছু আছে কিনা জানি না।

আমার মনে হয়, যে সমস্যাটা ১০ বছর আগেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ছিল এখনো আছে, তা হলো, নারীদের প্রতি তথাকথিত ভরসা করতে না পারার মানসিকতা। এতদিন পরেও, নারী সাংবাদিকরা অনেক হার্ড নিউজ কাভার করার পরও নিউজরুমের অনেক কর্তাব্যক্তিই মনে করেন, মেয়ে সাংবাদিকরা নির্মাণ করবেন সফট্ স্টোরি, কিংবা তাদের জন্য উপযুক্ত স্থান নারী শিশু বিট, নিদেনপক্ষে ফুল ফল লতা-পাতা টাইপের স্টোরি, যেসবের জায়গা হবে বুলেটিনের নিচের সারিতে কিংবা কাগজের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। হার্ড স্টোরি করার যোগ্যতা এখনো তাদের হয়নি। যদিও অনেকে হয়তো স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, নারী সাংবাদিকরা অনেক সময় পুরুষদের চাইতেও বেশি সচেতন, বিবেকবান, সৎ, অধ্যাবসায়ী ও পরিশ্রমী। যারা এরকম করে ভাবতে পারেন না তাদেরও হয়তো দোষ দেয়ার কিছু নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সব সময়ই মেয়েদের প্রতি এরকম দৃষ্টিভংগী পোষণ করা হয়। এরকম সমাজে মেয়েদের নিজেদেরই এ জায়গায় সংগ্রাম করে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। শ্রদ্ধা আর সম্মানের জায়গাটা অর্জন করে নিতে হবে যোগ্যতা আর দক্ষতা দিয়ে, এক্ষেত্রে বেশি বেশি কাজ করার কোন বিকল্প নেই।
 
সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাগুলোতে আরো বেশিসংখ্যক মেয়ে থাকতে হবে। যেহেতু মিডিয়াজগতে মেয়েদের পদচারণা পুরুষদের চেয়ে  অনেক পরে শুরু  হয়েছে সেহেতু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গাগুলোতে এখনো তারা খুব বেশি সংখ্যায় আসতে পারেননি। যদি বেশি সংখ্যক নারী উপরের পদগুলোতে আসেন তাহলে হয়তো অবস্থার পরিবর্তন হলেও হতে পারে। পাশাপাশি অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের এখানে এখনো অনেক পুরুষই নারীকে উর্ধতন অবস্থানে মেনে নিতে পারেন না। ফলে নানারকম অসহযোগিতা করে নারী বসকে বিপদে ফেলতে পারলে তারা বিমল আনন্দ অনুভব করেন। আবার অনেক সময় উপরের পদে গেলেও নারী যে তাঁর সহকর্মীদের প্রতি সঠিক আচরণ করতে পারেন তা-ও হয় না। নিজের ক্ষমতা পাকা-পোক্ত করার জন্য পুরুষতন্ত্রকে তুষ্ট করতে গিয়ে তিনিও পুরুষের মতেই আচরণ করতে শুরু করেন। ফলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। অফিসের অন্যান্য নারী সহকর্মীরা অবাক হয়ে উপলব্ধি করেন, পুরুষ বসের সঙ্গে নারী বসের আচরণগত কোনই তফাৎ নেই।   তারপরও বহুসংখ্যক মেয়ের উচ্চপদে উঠে আসা ছাড়া আপাততঃ নারী সাংবাদিকদের প্রতি প্রচলিত দৃষ্টিভংগী বদলানোর অন্য কোন বিকল্প চোখে পড়ছে না। যদিও আমাদের সমাজে  খুব কম সময়ই মেয়েরা তাদের যোগ্যতা বা দক্ষতা অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে পদোন্নতি পায়। বেশির ভাগ সময় এসব ক্ষেত্রে এতো বেশি দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা থাকে যে যোগ্যতাসম্পন্নরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পদ পান না। অবশ্য এটি তো আমাদের জাতীয় প্রবণতা, এতে দুঃখিত বা হতাশ না হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হবে।  

এখানে আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করাও খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না আশা করি, সেটা হচ্ছে, টেলিভিশন মিডিয়ায় সংবাদ উপস্থাপনায় নারীদের প্রচুর পরিমাণে উপস্থিতি এবং আগ্রহ। সংবাদ উপস্থাপনাকে অবশ্যই সাংবাদিকতা বলা চলে না। তবে বিপুল পরিমাণ নারী উপস্থাপিকাদের দেখে সাধারণ লোকজন ভাবতে পারেন, সাংবাদিকতায় বুঝি অনেক নারী এসে গেছেন। সত্যি বলতে কি, আমাদের দেশে মেয়েদের মধ্যে সাংবাদিকতা বা রিপোর্টিং করার চাইতে সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রেই আগ্রহ বেশি। এর কারণ হিসেবে মেয়েরা বলেন, অভিভাবকেরা রিপোর্টিংএর চাইতে সংবাদ উপস্থাপনার কাজটিকেই মেয়েদের জন্য বেশি পছন্দ করেন। তাদের মতে, এই পেশায় মেয়েদের বাইরে যেতে হয় না, ফলে কোন ঝুঁকিতেও পড়তে হয় না (যেন মেয়েরা বাইরে বের হওয়া মানেই ঝুঁকিগ্রস্থ হওয়া)  আবার অভিভাবকদেরও খুব বেশি দোষ দেয়া যায় না, কারণ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখনো এর নাগরিকদের বিশ্বাস করাতে পারেনি যে ঘরের বাইরের পরিবেশটা মেয়েদের জন্য নিরাপদ। যদিও প্রশ্ন জাগে, বাস্তবে বাইরের দুনিয়াকে যতখানি অনিরাপদ ভাবা হয় বাস্তবে পরিবেশটা কি ততখানি খারাপ? আবার এমন প্রশ্নও উঠতে পারে, যে ঘরকে আমরা নিরাপদ মনে করছি সেই ঘর কি সত্যিই নারীদের জন্য ততখানি নিরাপদ, যতখানি ভাবা হয় ? সেটা অবশ্য অন্য আলোচনা, তবে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মেয়েদের ঘরে আটকে রাখার কোন যুক্তি এখনকার সময়ে আছে কিনা তাও গভীর ভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। যারা এসব বলে মেয়েদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় আসা থেকে বিরত রাখতে চান  তারা  আসলে হয়তো নিজের অজান্তেই নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্বকে অনেক ক্ষেত্রে মেনে নিতে পারেন না। এক্ষেত্রে আরো দুঃখজনক তথ্য হলো, মেয়েদের জন্য সত্যিই যদি বাইরের পরিবেশটা অনিরাপদ হয়েও থাকে তবে সেটাও কিন্তু কিছু বিকৃতমনস্ক পুরুষের জন্যই হয়েছে।

জনমনে এমন একটি ধারণা আছে, সাংবাদিকতা পেশায় কোন বাঁধা ধরা সময় নেই, রাত-বিরাত নেই, এমনকি তাদের পারিবারিক জীবন বলতেও কিছু থাকে না, ফলে মেয়েদের জন্য পেশা হিসেবে এটি তেমন সুবিধাজনক নয়। কথাটা আংশিক সত্য হলেও এটা মনে রাখতে হবে যে সাংবাদিকতার মতো একটি চ্যালেঞ্জিং পেশায় আসতে হলে কিছু না কিছু ছাড় তো দিতেই হবে, কারণ এখানে কাজের প্রকৃতিটাই ভিন্ন। দশটা/পাঁচটা চাকরির জায়গা এটি নয়। যে মেয়েরা সাংবাদিকতা করছে, সাংবাদিকতায় আসতে চায় তাদের সবার এই সত্যটা মেনেই এই পেশায় আসতে হবে। তাদের পরিবারকেও আরো উদার ভাবে বিষয়টি দেখতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে।
ভারতীয় নারী সাংবাদিকদের নিয়ে করা সাম্প্রতিক একটি জরীপে দেখা গেছে, অনেক সময়ই নারী সাংবাদিকরা চাকরি ক্ষেত্রে পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি, এসাইনমেন্ট বিতরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈষম্যের কবলে পড়েন। কাজের জায়গায় পুরুষ সহকর্মী বা কর্মকর্তাদের যৌন হয়রানির কবলেও পড়তে হয় অনেককে । বাংলাদেশে এখনো এধরনের কোন জরিপ বা গবেষণা হয়নি, কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা যে একেবারেই ঘটে না, তা- কি নিশ্চিত করে বলা যাবে? 
     
অনেক সময় আমার পুরুষ সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, আপনারা অন্যকে নিজেদের নারী পরিচয়টাকে আড়াল করতে চান কেন, বলুন তো? অনেকেই বলেন, আমরা সাংবাদিক, নারী সাংবাদিক নই। এভাবে বলার কারণটা কি?

তাদেরকে বলি, ভাই, অনেক দুঃখে আমরা এঁটা বলতে বাধ্য হই। কারণ আমার পেশাগত পরিচয়ের আগে নারী শব্দটি জুড়ে দিয়ে আপনি আসলে আমাকে ছোট করতে চান, আমি আপনার চাইতে ইনফেরিয়র, এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করতে চান। নইলে নারীত্ব আমার  জৈবিক পরিচয়। একে অস্বীকার করার কারণ তো নেই। কিন্তু এই পরিচয় দিয়ে সমাজ আমাকে আমার পুরুষ সহকর্মীর চাইতে যখন এক ধাপ নিচে নামিয়ে দিতে চায়। তখন স্বাভাবিকভাবেই সমাজের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে আমি আমার পেশাগত পরিচয়টাকে আমার জৈবিক পরিচয়ের উর্ধে তুলে ধরতে বাধ্য হই। আমাকে বলতে হয়, আমি সাংবাদিক, নারী সাংবাদিক নই। নইলে নারীত্ব তো কোন অবমাননার বিষয় নয়। আমি নারী এটা আমার অহংকার, এটা আমার বৈশিষ্ট্য। আমার অনন্যতা।

আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করার কথা। বলা হয়েছে  প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল স্তরে নারীর সম ও পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথাও। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব কথা কি শুধু কথার কথা, শুধু বলার জন্যই বলা ?  নাকি কোন দিন এসব সত্যি সত্যি সত্য হবে?
সত্য হওয়ার জন্য নারী-পুরুষসহ সকলের মানসিকতা বদলানো দরকার, যা হয়তো রাতারাতি সম্ভব নয়, তবে এখন যেভাবে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বিশ্লেষণ হচ্ছে, তাতে আশা করা যায়, মানসিকতার পরিবর্তন হয়তো হবে ..   

লেখক: চিফ রিপোর্টার, এটিএন বাংলা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।