ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

গণমাধ্যমে উড়ছে নারীর বিজয়কেতন

তুষার আবদুল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:৩৫, মার্চ ৭, ২০১২
গণমাধ্যমে উড়ছে নারীর বিজয়কেতন

গণমাধ্যমে মেয়েদের এখন দাপুটে উপস্থিতি। কোনো বার্তাকক্ষেই মেয়েরা এখন আর সংরক্ষিত অবস্থায় নেই।

এক যুগ আগেও পত্রিকা বা টেলিভিশনে  ২০/২৫ জনের  রিপোর্টিং টিমে এক, দুইজন মহিলা রিপোর্টার রাখা হত। আবার বলা যেতে পারে রিপোটিং করার জন্য পাওয়া যেতো এক-দুই জন মেয়ে। কারণ মাঠে গিয়ে রিপোর্ট করার জন্য মেয়েরা তখনও নিজে থেকে তৈরি হয়নি। গণমাধ্যমে কাজ করতে যারা আসতেন বিশেষ করে পত্রিকায়, তাদের পছন্দের জায়গাটি ছিল নিউজ ডেস্ক। এখানে ৯-৫টা অফিস করাতেই ছিল তাদের স্বচ্ছন্দ। ডেস্কে রাতে ডিউটি করছেন, এমন সহকর্মী ছিল বিরল। কারণটা কেবল মেয়েদের একার তৈরি করা ব্যাপার নয়। সমাজ এবং পরিবারও তাদের মেয়েটিকে রাতে কাজের জন্য বাইরে রাখতে মানসিক প্রস্ততিটা নিতে পারেনি। গণমাধ্যম নিয়ে বাজারে ফ্যান্টাসির শেষ নেই। আগে ছিল এখনও আছে। সেই ফ্যান্টাসিগুলো মেয়েদের গণমাধ্যমে কাজের জন্য পাঠাতে পরিবার এবং সমাজকে দ্বিধার মুখে ফেলতো। এখনও তা-ই করছে। তবে সেই দ্বিধার দেয়ালে ফাটল ধরেছিল এক যুগ আগেই। এতদিনে, বলা যায়, ধসে পড়েছে সেই দেয়াল।

দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন দৈনিক, রেডিও, টেলিভিশন সর্বত্র মেয়েরাই এখন এগিয়ে চলেছে। কেবল বার্তাকক্ষের দেয়ালে বন্দি নয় তারা। তাদের দৃপ্ত পদচারণা মাঠে-ময়দানে। একসময় যে দুই-একজন মেয়েকে পাওয়া যেত রিপোর্টিং-এ, তাদের জন্যও আবার অবধারিত বরাদ্দ ছিল নারী ও শিশু কিংবা সংস্কৃতি বিষয়ক বিট।   যে কোনো  কোমল (সফট) রিপোর্ট তৈরির জন্য মেয়েদেরই ডাকা হত। এই অভ্যাসটা প্রথম বেসরকারি টেলিভিশনেও ছিল। ধীরে ধীরে ঐ টেলিভিশনে কাজ করা সহকর্মী নারী রিপোর্টাররা তাদের অবস্থান তৈরি করেছেন। নিউজের রান ডাউনে টপকে গেছেন পুরুষ সহকর্মীদেরও। পরবর্তী সময়ে যেসব বেসরকারি টেলিভিশন এসেছে, সেখানে নারী কর্মীদের ভিড় কেবলই বেড়েছে। কোথাও নারী এবং পুরুষ সহকর্মীর অনুপাত ৭০:৩০ ছিল। আবার কোথাও সেটা ৬০:৩০। যেখানে অনুপাতে নারীর সংখ্যা কম সেখানেও তার অবস্থান ৩০’র নিচে নয়। আর বদ্ধ দেয়ালের চেয়ে এই নারীদের উপস্থিতিটা পথেই বেশি। হোক তা রিপোটিং, অনুষ্ঠান নির্মাণ,  ক্যামেরাম্যান বা ভিডিও জার্নালিস্ট। সব ক’টি চ্যানেলেই মেয়েদের এই জায়গাগুলোতে খুঁজে পাওয়া যাবে। আর তাদের সংখ্যা এক নয়, অসংখ্য। রিপোর্টিং’র বেলাতে মেয়েরা কঠিনকে কেবল বেছে নেয়নি, জয়ও করেছে। এখন বরং কোমল বিষয়ে রিপোর্টের জন্য মেয়েদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা রাজনৈতিক, অপরাধ, সচিবালয়, সংসদ, নির্বাচন কমিশন, খেলাধুলা, ব্যবসা–বাণিজ্য বিষয়ক রিপোর্ট করে বেড়াচ্ছেন চুটিয়ে। দৃশ্যপটের এই বদল শুধু টেলিভিশনে নয়, পত্রিকাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমেও এসেছে।   সেই পত্রিকা এবং টেলিভিশন দুই জায়গাতেই ক্যামেরা-হাতে মাঠে নেমে এসেছেন মেয়েরা। সমাবেশ, সংঘর্ষ, দুর্যোগে মেয়েরা ছুটে যাচ্ছেন ক্যামেরা-হাতে। আরেকটি প্রাপ্তি যোগ হয়েছে টেলিভিশনে, তাহলো প্যানেল প্রডিউসার যারা লাইভ সংবাদ প্রযোজনা করেন, সেখানেও অর্থাৎ প্রোডাকশন কন্ট্রোল রুমেও (পিসিআর) চালকের আসনে বসে পড়েছেন মেয়েরা। বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন বেশ ক’জনা।
প্রাপ্তিযোগ যে ষোল আনা জুটেছে সেই দাবি করছি না। কিন্তু দশ আনার দাবি করতে পারি। এখনও টেলিভিশনে মেয়েরা এসে সংবাদ উপস্থাপিকা হবার আগ্রহটাই রাখছেন বেশি,  ডেস্কের প্রতি দুর্বলতা কাটেনি কারো কারো। পত্রিকাতে লোভ আছে অনেকের ফিচার পাতায় বা অনুবাদের কাজে ডেস্কে বসে যাওয়ার। রাতে ডিউটি করার আপত্তিটাও ফুরিয়ে যায়নি। এইসব কিছুর জন্য এককভাবে মেয়ে সহকর্মীদের দায়ী করতে পারছি না । এজন্য পরিবার, সমাজ এবং কাজের ক্ষেত্র ও পরিবেশকেও সমান দায়ী করছি। পরিবার ছেলের জন্য যা ভাবতে পারছে মেয়ের বেলাতে সেকরমটি ভাবতে পারছে না। ছেলেটি রাতে ডিউটি করলে বা বাইরে মাঠে-ঘাটে কাজ করলে আপত্তি নেই। আপত্তি মেয়েটির বেলাতে। এমনকি স্বামী-স্ত্রী দু’জনই হয়তো গণমাধ্যমকর্মী। স্বামী রাতে ডিউটি করবেন, মাঠে গিয়ে রিপোর্ট করবেন, কিন্তু স্ত্রীর বেলাতে সেটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাকে গণমাধ্যমে চাকরি করতে দিচ্ছেন না।
সামাজিক অবস্থানটা বরং একটু অবস্থানগতভাবে ভাল দিকেই আছে। সমাজ অনেকটাই সম্মানের চোখে দেখতে শুরু করেছে গণমাধ্যমের নারীকে। কিছু ব্যতিক্রম যে নেই তা বলছি না। তবে কাজের ক্ষেত্রগুলোতে কিন্তু ঝামেলাটা রয়েই গেছে। এখানে অভিযোগ আছে যৌন হয়রানির। মেয়েরা সকল গণমাধ্যমকে যে নিরাপদ ভাবতে পারছেন এ দাবিও পুরোপুরি করা যাচ্ছে না। কাজ বণ্টনের মধ্যেও রয়ে গেছে বৈষম্য। নারীর কাজের ক্ষমতার চেয়ে এখানে তার রূপ ও সৌন্দর্যটাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ বলতে দ্বিধা নেই, নারীকে কাজের পরিবেশ দেয়ার জন্য আগে যে জায়গাটির তৈরি হবার কথা ছিল, সেটি অনেকটা পিছিয়ে আছে। জায়গাটি এখনও পুরুষালি দৃষ্টিভঙ্গির দোষে দুষ্ট। তবে সম্ভাবনার কথা হল- সেই দৃষ্টিভঙ্গি ঝাপসা হতে শুরু করেছে। এখানে ভিড় বাড়ছে তারুণ্যের। যাদের কাছে পুরুষ-নাকি নারী সেই লিঙ্গ বিবেচনা নেই। বিবেচনার বিষয় হচ্ছে নারী-পুরুষ উভয়েই গণমাধ্যমকর্মী। আর এই কর্মীর কাজ করার অধিকার ও যোগ্যতা সর্বত্র। গণমাধ্যমের সেই ভবিষ্যমুখি, প্রগ্রহর নতুন দৃষ্টির সুবাদে দ্বিধা- প্রতিবন্ধকতার দেয়াল ডিঙিয়ে যে নারীরা আজ গণমাধ্যমে জয়িতা, অভিবাদন তাদের!

লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টেলিভিশন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।