ঢাকা, সোমবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

স্কুল পড়ুয়াদের বিদ্রোহের গল্প

বাবু আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৫৯, মার্চ ৮, ২০১২
স্কুল পড়ুয়াদের বিদ্রোহের গল্প

১৬ জুন, ১৯৭৬। দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিন।

এদিন শত শত স্কুল শিক্ষার্থীরা অধিকার আদায়ের জন্য বিদ্রোহ করে ওঠে। যে বিদ্রোহে প্রাণ যায় অনেক শিক্ষার্থীর। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে কয়েকজন স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা মিলেই বদলে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস।

কী হয়েছিল সেদিন? ইতিহাস থেকে জানা যায় সেদিন পুলিশের পাহারা বন্ধ ছিলো। এমন সময়ই শিক্ষার্থীদের ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে বারুদের মত। সেই আগুন নেভানোর জন্য পুলিশের হাতে একটাই উপায় ছিল। নিষ্ঠুরভাবে তাদের আন্দোলনে আগ্রাসন চালানো হয়।

এবার জানা যাক পেছনকার ঘটনা। কেন হুট করে স্কুল পড়ুয়া কিছু ছেলেমেয়ে বিদ্রোহ করে ওঠে। আগে দক্ষিণ আফ্রিকার কালোরা মিশনারি স্কুলে পড়ার সুযোগ পেত। হঠাৎ ন্যাশনাল পার্টি ১৯৫৪ সালে বান্টু ভাষার প্রচলন করে। এর ফলে শিক্ষর্থী সংখ্যা বাড়তে থাকলেও নামতে থাকে শিক্ষার মান।

ফিলিপ বোনার এবং লরেন সিগালের ভাষ্যমতে, ‘১৯৬১ সালের আগে বা পরে মাত্র ১০ ভাগ কালোদের ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেট ছিলো। স্কুলগুলো ছিল সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত। কোন কোন স্কুলে ছিল না গবেষণাগার এবং খেলার মাঠ। এমনকি অনেক স্কুলে লাইব্রেরি পর্যন্ত নেই।

১৯৭৬  সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বান্টু ভাষায় গণিত এবং সোশ্যাল স্টাডিজ এবং ইংরেজিতে সাধারণ বিজ্ঞানের সাথে ব্যবহারিক বিষয় যেমন গার্হস্থ্যবিদ্যা, কাঠের কাজ শেখানো হবে।

এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ছিল ৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়া। যার ফলে রক্ষণশীল আফ্রিকান/বান্টুভাষীরা মনে করতো এর ফলে হয়তো ইংরেজির অবস্থা আরো শক্তপোক্ত হবে এবং বান্টু ভাষা তার নিজস্বতা হারাবে‌। এর সাথে আরো একটা কারণ ছিলো কালোদের দৃঢ়তা। তখন সরকার মনে করতে থাকে এই বান্টু ভাষার শিক্ষা ব্যবস্থা হলে অদূর ভবিষ্যতে যে বিদ্রোহের সম্ভাবনা আছে তা সামাল দেয়া যাবে।

অন্যদিকে যেখানে সাদা শিশুদের জন্য বিনামূল্যে স্কুলের ব্যবস্থা ছিল সেখানে প্রতিটি কালো শিশুদের জন্য তাদের বাবা-মা’র এক মাসের বেতনের প্রায় অর্ধেক দিতে হতো। এর সঙ্গে ছিলো বই, স্টেশনারি কেনার খরচ। এমনকি স্কুল তৈরির অনুদানও দিতে হতো।

৫ মার্চ, ১৯৭৬ সালে দ্য ওয়ার্ল্ড নিউজপেপারে এক রিপোর্টে বলা হয়, ‘স্কুলগুলো ছুটির পর যখন খুলতে শুরু করে তখন শিক্ষক এবং কালো শিশুদের অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা যেতে থাকে। যদিও বান্টু ভাষার স্কুলগুলো অধিকাংশই সরাসরি ডিরেক্টিভ বোর্ড থেকে কয়েকটি শর্তের ফলে বাধ্য ছিলো কিন্তু তারপরেও প্রতিটা ব্যবস্থায় অসামঞ্জস্যতার ফলে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে। ‍

পরের মাসগুলোতে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। এরই মধ্যে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে চলে আসে পরীক্ষা। ১৩ জুনে, ১৯৭৬  এক সভায় প্রায় ৪০০জন শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়। এখানেই সবাই আবিষ্কার করে ১৯ বছর বয়সী এক নেতাকে। যার নাম সিয়েতসি মাশহিনিনি।

পরের বুধবার ১৬ই জুন তারা একটি বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়। যেখানে সিদ্ধান্ত হয় এ সমাবেশের কথা তারা বাসায় বাবা-মাদের জানাবে না। এর কারণ একটাই; বাবা-মা এ আন্দোলনের খবর পেলে তাদের বাধা দেবে। তাই তারা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৬ জুন নিয়ে তাদের অনেক প্রত্যাশা ছিলো  একটাই। সেটা হলো, শাসকগোষ্ঠীকে দেখানো যে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বের হয়ে আসছে। শাসকরা থামানোর চেষ্টাও করবে। শাসকদের সব চেষ্টায় বাধা দিয়ে তারা দেখিয়ে দেবে এই দিনটিই শিক্ষার্থীদেরই।

প্রতিক্ষিত ১৬ জুনের সকালটা ছিল খুব সুন্দর। ঠান্ডা আবহাওয়া। তাদের পরিকল্পনামত শিক্ষার্থীরা দলে দলে সোয়েটো স্কুলের মাঠে জড়ো হয়। সবার মিলিত সিদ্ধান্তে তারা অরল্যান্ড সেকেন্ডারি স্কুল থেকে অরল্যান্ড স্টেডিয়ামের দিকে যাত্রা শুরু করে। ১০:৩০ এর মধ্যেই প্রায় ৫০০০ ছাত্র ভিলাকাজির রাস্তায় জড়ো হয়। প্রতি মিনিটে জড়ো হতে থাকে আরো অনেক ছাত্র। অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকে রাস্তার মানুষ। স্কুল ইউনিফর্ম পরে মাত্র ১০-২০ বছর বয়সের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী পথযাত্রায় অংশ নেয়।

স্টেডিয়ামে গিয়ে তারা আবার সমাবেশ করে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় জোহান্সবার্গের দক্ষিণ শহরতলীর ট্রান্সভালের শিক্ষা অধিদপ্তরের দিকে রওনা হবে। কিন্তু সেই পরিকল্পনামত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। পুলিশের তৈরি করা প্রাচীর বন্ধ করে তাদের যাত্রা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। ভয়বহ বিষয়টি ছিল স্কুল শিক্ষার্থীদের দমাতে কুকুর ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন অবস্থার মধ্যে কেউ রাস্তা ছেড়ে যায়নি। বরং তারা পুলিশের দিকে ইট পাটকেল ছুড়ে তাদের দৃঢ়তার জানান দেয়।

জন জন এমখোনজা নামে এক ছাত্রের উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, ছাত্ররা কিছুক্ষণ পর পরই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলো। তারা কেউ কেউ পালিয়ে যাচ্ছিল আবার ফিরে আসছিল। অনেকে লুকিয়ে লুকিয়ে পুলিশের উপর হামলা করছিল।

পুলিশের কিছু গতি করতে না পেরে গুলি ছোড়া শুরু করে। মারাত্মকভাবে আহত হয় ১২ বছর বয়সী হেক্টর পিটারসন।

পিটারসনকে ক্যামেরায় ধরে ছিলেন স্যাম এজিমা নামক এক আলোকচিত্রী। তিনি বলেন, ‘একটি বাচ্চাকে পড়ে যেতে দেখলাম। এরপরেই শুরু হয় বুলেট বৃষ্টি। তখনই আমি হেক্টরের শেষ ছবিটা তুলি’। সেই ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। এবং সাথে সাথেই হয়ে ওঠে সেই বিদ্রোহের প্রতীক। বিশ্বের কাছে তুলে ধরে জাতিগত বিদ্বেষের এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

বহু ছেলেমেয়ে আহত হতে থাকে। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। অনেকে হাসপাতালের করিডরেই মারা যায়। কেউ কেউ মারা যায় রাস্তাতেই। এরপরেই নামে রাত। শহরটিতে তখন নরকের আগুন জ্বলছে। রাতের অন্ধকারে পুলিশ অন্ধের মত গুলি ছুড়তে থাকে। ছাত্ররাও এর জবাব দিতে থাকে পাথর আর কাঁচের বোতল দিয়ে।

Africaবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গ থেকে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত। এরই মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়া এবং সোয়েটর সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

বেশিররভাগ নিহতের বয়স ছিল ২৩ এর মধ্যে। অনেকেই পরবর্তীতে পঙ্গু হয়ে পড়েন। বছরের শেষ পর্যন্ত মারা যায় প্রায় ৫৭৫ জন। এর মধ্যে পুলিশের হাতেই নিহত হয় প্রায় ৪৫০ জন। আহত হয় প্রায় ৫ হাজার। পুলিশ এদের মধ্য থেকে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। গ্রেফতার করে প্রায় ৬হাজার শিক্ষার্থীকে।

অভ্যুত্থান এর সাথে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সমর্থন একটা ফল এনে দেয়। তারা ছাত্রদেরকে যতটুকু সম্ভব সমর্থন দিতে থাকে। জাতিবিদ্বেষি সরকারকে এর দমন-পীড়ন্মুলক নীতি প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকে। ১৯৯০ সালে এই আন্দোলন বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত পুরো আশির দশক জুড়েই আন্তর্জাতিক এই চাপ অব্যাহত থাকে।

স্কুল প্রধানরা বাধ্য হয় তাদের নিজস্ব মাধ্যমে শিক্ষ্যা ব্যবস্থা চালু করতে। একটি টিচার’স ট্রেনিং স্কুল এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আরো অনেক স্কুল তৈরি হয়। শিক্ষকদের মান বাড়াতে তাদের বেতন-ভাতা সহ সব ধরনের প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো শহরের পরিবর্তন। কালোরা শহরের নাগরিকত্ব পাওয়া শুরু করে। তাদের আবাসস্থলের পাশেই করা গড়ে তোলা হয় শিল্প কারখানা।

এতো পরিবর্তন হলেও পুলিশের দমন পীড়ন শেষ হয়নি। হাজার হাজার শিক্ষার্থী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাদের শিক্ষাগ্রহণ অসম্পূর্ণ থাকায় তারা শেষ পর্যন্ত মিলিটারিতে যোগ দিয়ে ট্রেনিং নিতে থাকে। অবশেষে আশির দশকে জাতিগত বিদ্বেষ, হত্যাকান্ড শেষ হয়।

নব্বয়ের দিকে অধিকাংশ মানুষজন আফ্রিকায় ফিরতে থাকে এবং প্রস্তুত হয় ৯৪ এ জন্ম নেওয়া গণতন্ত্রকে স্বাগতম জানানোর জন্য। এরপরেও মানুষ ভুলতে পারে না সেই দিনের কথা।

এই আন্দোলনে প্রথম নিহত হওয়া হেক্টরের নামে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।