শ্রীপুর(গাজীপুর) : ফুটবল যেন তার কথা শুনে। মাথায় হাওয়া ভর্তি টনটনে একটি বল, তার ওপর বালি ভর্তি একটি গ্লাস, গ্লাসের বালিতে পুঁতে রাখা হয়েছে বাঁশের কাঠিতে বাঁধা জাতীয় পতাকা- এ অবস্থায় মফিজ হেঁটে চলছেন সড়কের পাশ দিয়ে।
মাথায় বল নিয়ে নারকেল বা খেজুর গাছে ওঠা, সাঁতার কাটা, জামা কাপড় পরা, টেলিভিশন দেখা, ভাত খাওয়া থেকে শুরু করে পায়খানা-প্রস্রাব সবই করতে পারেন বল মাথায় নিয়ে। দু’আঙ্গুলে দু’টি বল এক সাথে ঘুরাতে পারেন তিনি দীর্ঘ সময় ধরে। লম্বা কাঠির ওপর বল ঘুরাতে পারেন। মাটিতে গড়াতে পারেন মাথায় বল রেখে। ঝুলতে পারেন শূন্যে। এক হাতে বালতি অন্য হাতে মগ নিয়ে টিউবওয়েল চেপে বালতিতে পানি ভরেন, শরীরে সাবান মেখে গোসল করতে পারেন। এ সময়ও মাথায় থাকে বল। বল শূন্যে রেখে টানা ৫শ’ বার হেড করতে পারেন এমনকি ঘাড়ে বল রেখে দিব্যি ঘুমাতেও পারেন। যেকোনো মিছিলে মাথায় স্থির বল নিয়ে অংশ নিতে পারেন তিনি। এক সাথে ৬/৭টি বল নিয়ে নানা কৌশলে চমক লাগানো ক্রীড়াশৈলী তার আয়ত্তে।
ফুটবল নিয়ে এতসব চমৎকারিত্ব দেখানেওয়ালার নাম মফিজুল হক প্রধান। ফুটবলের একজন দক্ষ ও সুনিপুণ যাদুকর বলা যায় তাকে। যার ফুটবল-কাণ্ডে মুগ্ধ হয়েছেন দেশে ও দেশের বাইরের হাজারো দর্শক। বিশ্ব জয়ের নেশায় মফিজ তার জীবনের প্রায় পুরো অংশই বিনিয়োগ করেছেন এই ফুটবল সাধনায়। ছোটবেলা থেকেই মফিজের সমস্ত ধ্যানজ্ঞান ফুটবল নিয়ে নানান কসরৎ।
ফুটবলের যাদুকরী সব খেলা দেখতে সারাদেশ থেকে ডাক আসে। বছরের অধিকাংশ সময়ই তিনি এই খেলা দেখান দেশের বিভিন্ন নামিদামি মাঠে। ইতোমধ্যে দেশের ৩৭ জেলায় খেলা দেখিয়েছেন। অর্জন করেছেন শত শত পুরস্কার আর মানুষের ভালোবাসা।
মার্চ মাসের শুরুতে শ্রীপুরের মাওনা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শাপলা সমাজ কল্যাণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত বঙ্গবন্ধু কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় মফিজ তার ফুটবল শৈলী দেখিয়ে প্রায় ৩৫ হাজার দর্শককে মুগ্ধ করেন। বিকেল ৪টায় খেলা শুরুর কথা থাকলেও দুপুর একটার আগেই বিশাল ওই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। আর এরই ফাঁকে মফিজ দেখাতে থাকেন তার চমকপ্রদ নানা খেলা। তিনি খেলা দেখানোর সময় প্রায় ৩ ঘণ্টা করতালিতে মুখরিত ছিল ৩৫ হাজার দর্শকের ওই মাঠ।
শুরুর কথা : গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বদিকে কাপাসিয়ার কায়েদ ইউনিয়নের আমরাইদ গ্রামের সিরাজুল হক প্রধানের ছেলে মফিজুল প্রধান তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ওই ক্লাসে বাংলা চয়নিকা বইয়ে ছবিসহ ‘ফুটবলের রাজা কালো মানিক’ শিরোনামে একটি লেখা ছিল। ছবিতে দেখানো হয়েছিল, কালো মানিকের মাথার ওপর একটি বল আর তিনি বাদাম খাচ্ছেন। গল্পের এই ছবি দেখে মফিজ অনুপ্রাণিত হন। মফিজের বয়স তখন বছর দশেক। পেলের মত বাদাম নয়, মাথায় বল রেখে ভাত খাবেন, মাথায় বল নিয়ে রাস্তা চলবেন- এমন সব ইচ্ছাকে পুঁজি করে শুরু করেন ফুটবল সাধনা। রপ্ত করতে থাকেন নানা কৌশল। এরই ফাঁকে ফুটবল খেলায়ও তিনি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পুরো জেলায় তিনি ভাড়ায় (খেপ) খেলা শুরু করেন। খেলার ফাঁকে ফাঁকে মানুষকে দেখাতে থাকেন ফুটবল নিয়ে নানা রকম কসরত।
১৯৯০ সালে আমরাইদ একুব আলী সিকদার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তবে ফুটবলের নেশায় এরপর পড়াশুনা এগোয়নি আর। ২০০৮ সালের দিকে গাজীপুর জেলা প্রশাসক মফিজকে ‘ফুটবলের যাদুকর’ বলে আখ্যায়িত করেন।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন ৪১ বছর বয়সী এই ফুটবল-যাদুকর। কিন্তু বিশ্বজয়ের যে নেশা তিনি লালন করছেন গত ৩০ বছর ধরে; সেটা পূরণের অপেক্ষায় আজো মফিজ সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

১৯৯৮ সালের ঘটনা। জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। সেখানে তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাস্তা-ঘাটে খেলা দেখিয়ে হাজারো মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন। যে কোম্পানিতে তিনি চাকরি করতেন সেই কোম্পানির ম্যানেজার একদিন মফিজকে নিয়ে গেলেন কুয়ালালামপুরের সেন্টু স্টেডিয়ামে। সেদিন পুলিশ বাহিনীর বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান চলছিল। ৩০ হাজার দর্শকের ওই স্টেডিয়ামে খেলা দেখানোর ঘটনা তার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা বলে জানান। মালয়েশিয়া থেকে খেলা দেখাতে যান সিঙ্গাপুর। প্রায় ৩ বছর ওই দু’টি দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি খেলা দেখিয়েছেন। পরে দেশে ফিরে এসে আবার সেই সাধনা।
আমরাইদ ইউপি সদস্য রইস উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, মাথায় বল নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একদিন মফিজ বিশ্ব রেকর্ড গড়বে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। গাজীপুরের বিশিষ্ট ধারাভাষ্যকার ও আবৃত্তিশিল্পী ইকবাল আহমেদ নিশাত বলেন, এ বছর যেমন বাংলাদেশের মাগুরার শালিখা উপজেলার ছয়গিরির আবদুল হালিম মাথায় বল নিয়ে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রমের বিশ্ব রেকর্ড করেছেন এবং ২০০৯ সালে এই রেকর্ড গড়েছিলেন মালয়েশিয়ার ই মিং লো। তাদের মতো আমাদের মফিজও একদিন গিনেস রেকর্ডস বুকে নিজের নাম লেখাতে সক্ষম হবেন।
স্ত্রী রুমা আক্তার শিমু, পুত্র ইয়াসিন ও সাকিনকে নিয়ে মফিজের সংসার। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবাই গর্বিত তাকে নিয়ে। একদিন সমগ্র জাতি গর্বিত হবে তাকে নিয়ে- এ আশা নিয়ে মফিজ এগিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময় : ১৮৩১ ঘণ্টা, ১০ মার্চ, ২০১২