ঢাকা : প্রজ্ঞা আর নিরন্তর সাধনায় সাধারণও অনেক সময় অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠেন। ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এ সত্যটি নতুন করে আবারও প্রমাণ করলেন রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কবি বলভদ্র দাস।
তিনি প্রমাণ করলেন, কাজ যত সামান্যই হোক, সততা আর নিষ্ঠা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা কখনোই ম্লান করে না মানুষকে। আর সত্য ও সুন্দরের সাধনা মলিন মানবকেও ধীরে ধীরে সন্তে পরিণত করে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য আসামের ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় নৈসর্গিক রাজধানী গুয়াহাটি শহরে সংসার চালাতে টানা ২০ বছর রিকশা চালাচ্ছেন বলভদ্র। সেই সঙ্গে নীরবে-নিভৃতেই চলছিল তার কবিতা আর সংগীত চর্চা। জীবনের কঠিন-কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও ধরে রেখেছেন শিল্প-সাহিত্যচর্চা। এ যেন ‘পাঁকে ডুবলেও পঙ্কজকে না ভোলা’। জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকেই রূপায়িত করেছেন তার অপরূপ সুন্দর কাব্য প্রচেষ্টায়।
না, জীবনের অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসেও বলভদ্রের এ কাব্য অনুরাগ তাকে একেবারে জলে ফেলেনি। সামান্য রিকশাওয়ালা হয়েও আগরতলা বইমেলার সাংস্কৃতিক সভায় রাজ্যের মন্ত্রী, পদস্থ সরকারি আমলা, প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক আর সমাজের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে এক আসনে বসতে পারার পর, স্বভাবতই এই অনুভূতি জাগ্রত হয়ে ওঠে তার মধ্যে-‘জীবন একেবারে ব্যর্থ হয়ে যায়নি’।
কলকাতার জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার প্রকাশ করেছে কবি বলভদ্রের ‘কবি’ স্বীকৃতি লাভের ইতিবৃত্ত। দরিদ্র ঘরের সন্তান বলভদ্র অষ্টম শ্রেণীর পর আর পড়ালেখার সুযোগ পায়নি। সংসারের হাল ধরতে প্রায় ২০ বছর আগে গ্রামের বাড়ি বরপেটা থেকে গুয়াহাটি শহরে পাড়ি জমান তিনি। সম্মানজনক কোনো কাজ যোগাড় করতে না পেরে বাধ্য হয়েই রিকশা চালানোর কাজ বেছে নেন। কিন্তু দারিদ্র্য দমাতে পারেনি তার শিল্পচর্চা।
জীবিকার সংস্থানে রিকশা চালনা, কাব্যচর্চা আর ভূপেন হাজারিকার মানবতাবাদী সংগীত চর্চা সমান তালে চলতে থাকে। নিজ জীবনের হতাশা, দুঃখ আর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সমাজের নানা ঘটনা উপজীব্য হয়ে ওঠে বলভদ্রের কবিতায়।
রিকশা চালকের বাইরে বলভদ্রের অন্য পরিচয় অন্তরালেই থেকে যেত। রেডিও আকাশবাণীর গীতিকার-অভিনেতা দিলীপ ফুকন একদিন বলভদ্রের রিকশায় চড়েন। এরপরই ঘুরে যায় প্রেক্ষাপট। বলভদ্রের গানে, আবৃত্তিতে মন্ত্রমুগ্ধ দিলীপ ফুকন তাকে নিয়ে যান হেঙরাবাড়ির নিজ বাড়িতে । সেখানেই সাহিত্যসভার উপ-সভাপতি পদুমী গগৈ ও অভিনেত্রী চেতনা দাসের উৎসাহে বলভদ্র বই বের করার সুযোগ লাভ করেন।
লেখক-প্রকাশক সৌমেন ভারতীয়া প্রকাশ করেন বলভদ্রের ৫০টি কবিতার সঙ্কলন ‘সরু পথিক, দুখর পথিক’ (তুচ্ছ পথিক, দুঃখের পথিক)।
গত ডিসেম্বরে রিকশাওয়ালা কবির বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন, সাহিত্যিক হোমেন বরগোহাঞি ও ত্রিপুরার শিক্ষামন্ত্রী অনিল সরকার। বলভদ্রের কবিতার প্রতি অনুরাগ ও তার কণ্ঠে ভূপেন হাজারিকার গান শুনে মন্ত্রী অনিল সরকার তার বক্তব্যে আগরতলা বইমেলায় কবি বলভদ্রকে সংবর্ধিত করার ঘোষণা দেন।
ত্রিপুরা সরকার বলভদ্রের জন্য পাঠান বিমানের টিকিট । ২৯ ফেব্রুয়ারি ৩০তম আগরতলা বইমেলায় বিশেষ সরকারি অতিথি হয়ে অনুষ্ঠানে হাজির হন কবি বলভদ্র । তার কাছে এ যেন স্বপ্নের মতোই। মন্ত্রী, আমলা, বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সঙ্গে এক মঞ্চে বসতে পারার বিরল সম্মানে অভিভূত কবি তার বক্তব্যে আবেগ তাড়িত ভাষায় বলেন, এই স্বীকৃতি, এত সম্মান পাব, সত্যিই ভাবিনি।
একই সঙ্গে ঘোষণা করলেন, শত প্রতিকূলতাতেও কবিতা লেখা যেমন ছাড়িনি, তেমনই ছাড়ব না রিকশার হাতলও। কারণ পরিচিতি, সম্মান, প্রথম বিমানে চড়া-সবই তো এই রিকশার বদৌলতেই!
বাংলাদেশ সময় : ১২১৭ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১২