বগুড়া: তাদের কাছে অনেক বিষয় জানবার আছে। শেখারও আছে অনেক কিছু।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাদের জন্ম, বিংশ শতাব্দী পেরিয়েছেন সেও একযুগ আগে। এখন একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিলিয়ে যাচ্ছেন সঞ্চিত অভিজ্ঞতা।
ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তান শাসনামলসহ তারা দেখেছেন ’৪৭-এর ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ।
নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে এসেছেন তারা। এমনই অভিজ্ঞতার সম্ভার যাদের, তারা হলেন- অভরসা মোল্লা (১৩৭), সৈয়দ জামান (১১৫) ও মিছিরণ বেওয়া (১১২)।
অভরসা মোল্লা বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের গোবিন্দপুর (ইসলামপুর) গ্রামের মৃত সেফাত মোল্লার ছেলে, সৈয়দ জামান বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী দক্ষিণপাড়ার মৃত জয়ন প্রামাণিকের ছেলে এবং মিছিরন বেওয়া শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের গোবিন্দপুর সরকার পাড়ার মৃত আশরাফ আলীর স্ত্রী।
সাড়ে ৫ ফুট উচ্চতার অভরসা মোল্লার চামড়া শুকিয়ে শরীরে বয়সের ছাপ লাগলেও দাঁত পড়েছে মাত্র দু’টি। রোগহীন ১৩৭ বছর বয়সের এই মানুষটির জন্ম হয়েছিল ১৮৭৫ সালের মাঝামাঝিতে।
নামাজ-কালাম পড়া, খাওয়া-দাওয়া ও বেড়ানোসহ একাই গোসলখানা পর্যন্ত যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, ১২০ বছর বয়সের মাথায় তৃতীয় বিয়ে করেন তিনি।
তিন স্ত্রীর মধ্যে প্রথম স্ত্রী জোয়ালেমন ১৬ বছর আগে মারা গেছেন। ছোট দুই স্ত্রী জবেদা ও আমেনা স্বামীর দেখাশোনা করেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও মানসিকভাবে তিনি দারুণ সাহসী। কথাও বলেন স্পষ্ট। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় ও সঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়াসহ লাঠির ওপর ভর করে এখনও একাই চলাফেরা করেন।
অভরসা মোল্লা বাংলানিউজকে জানান, গত ৪০ বছরে এক ওয়াক্ত নামাজ ও কোনো রোজা তিনি কাযা করেননি। তিনি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে জানান, এতো বছর বয়সে আল্লাহ তাকে সুস্থ রেখেছে এটাই বড় কথা।
তিনি বলেন, ‘নাতি-নাতনিদের বিয়ে দিয়েছি, তাদেরও সন্তান হয়েছে। তাদের সঙ্গেই অবসরে কথা বলি। আগে ৩২ বিঘা জমি নিজ হাতে হাল-চাষসহ সংসারের সব কাজ করেছি। জীবনের সমস্ত কিছু পার করে এই বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছি। যেকোনো দিন চলে যেতে হবে তারই অপেক্ষা এখন । ’
অভরসা মোল্লার মেজো ছেলে আব্দুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, তারা তিন ভাই ও আট বোন। তাদের পরিবারে এখন সদস্য সংখ্যা ৪২ জন।
তিনি জানান, তার বাবা প্রায় ৪০ বছর গোবিন্দপুর পুর্বপাড়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার শখ খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করা। যদিও বয়সের কারণে এখন আর তিনি গাছে উঠতে পারেন না।
তার ছোট স্ত্রী আমেনা জানান, ১৩৭ বছর বয়স হলেও তিনি সবকিছু একা করতে ভালোবাসেন। চোখে একটু ঝাপসা দেখলেও কেউ পরিচয় দিলে তাকে চিনতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল হালিম (৪৫) জানান, আমরা ছোট থেকেই তাকে দেখে আসছি। তার বয়স ১৩০ থেকে ৪০ এর মধ্যেই হবে।
সেখানকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আইয়ুব হোসেন (৫৮) জানান, তার মায়ের বিয়েতে মুরুব্বি হিসেবে অভরসা মোল্লা উপস্থিত ছিলেন বলে তিনি তার মায়ের কাছে শুনেছেন।
প্রায় সোয়া ৫ ফুট উচ্চতার সৈয়দ জামান বয়সের ভারে নয়, সংসারে অভাব, অভিযোগ আর অসুস্থতার কারণে নুয়ে পড়েছেন বলে দাবি তার পরিবারের সদস্যদের। যে মানুষটি এসএসসি পাস করে ১৮৭২ সালে বাংলাদেশ আনসার বাহিনীতে কাজ শুরু করেন তারতো এত সহজেই কাবু হওয়ার কথা নয়।
১৮৯৭ সালে জেলার গাবতলী উপজেলার নেপালতলী ইউনিয়নের সরাতলীতে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি অনেক কষ্ট করে জানান, সংসারে অভাব না থাকলে শরীর তার এতোটা খারাপ হতো না।
চিকিৎসার অভাবে ১৯৭১ সালে স্ত্রী সাইবেনি বেগম মারা যাওয়ার পর জামানের ব্যক্তি জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে। পরবর্তী জীবনে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বগুড়া শহরে এসে কাঠের অসবাবপত্র তৈরির পেশা বেছে নেন।
আদর-যত্ন করে চার ছেলে ও তিন মেয়েকে বড় করতে পারলেও উচ্চশিক্ষিত করতে পারেননি বলে প্রতিনিয়ত ছেলেমেয়েদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে তিনি মানুষকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি একসময় গ্রামের বাড়িতে মসজিদের ইমামতিও করেছেন।
৭০ বছর বয়সী বড় ছেলে সারোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, মা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা যেটুকু লেখাপড়া করতে পরেছে সেটাই শেষ। এর পরে আর এগুনো সম্ভব হয়নি।
মিছিরন বেওয়ার জন্ম হয়েছে ১৯০০ সালের প্রথম দিকে। বিবাহিত জীবনে তার দুই মেয়ে, তিন ছেলে ছাড়াও ৩২ নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। বয়সের কারণে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় না করতে পারলেও বসেই নামাজ আদায় করেন কুরআনে হাফেজ এই নারী।
মিছিরন বেওয়া বাংলানিউজকে জানান, তার নানা রকম অভিজ্ঞতার কথা। জানান পাক-ভারত যুদ্ধ, আগরতলা ষড়যন্ত্র, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের নানা কথা।
তিনি জানান, মাত্র ৭ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় ১৬ বছরের ছেলের সঙ্গে। স্বামীর কাছে অনেক আদর, যত্ন আর ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। এ সময় পড়েছেন লাইলি মজনু, শিরি ফরহাদসহ অনেক বই।
সস্তার সেই সময় কি আর আসবে- এমন আক্ষেপ করেন মিছিরন বেওয়া। মানুষের অভাব এখন বেশি- উল্লেখ করে তিনি জানান, তখন এক পয়সা সের গরুর মাংস ও দেড় টাকায় বিয়ের সবচেয়ে ভালো শাড়ি পাওয়া যেতো।
তার আশা মৃত্যুর আগে তিনি মারামারি, কাটাকাটি ও হানাহানিমুক্ত শান্তিপূর্ণ দেশে দেখে যেতে চান।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১২
প্রতিবেদন: টিএম মামুন
সম্পাদনা: তানিয়া আফরিন, নিউজরুম এডিটর/রোকনুল ইসলাম কাফী, নিউজরুম এডিটর/
চূড়ান্ত সম্পাদনা: সাইফুল ইসলাম, কান্ট্রি এডিটর