ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

আন্তরিকতা-প্রযুক্তির সমন্বয়ে অজ্ঞাত রোগের চিকিৎসা সম্ভব: ডা. শক্তি রঞ্জন

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০২৩
আন্তরিকতা-প্রযুক্তির সমন্বয়ে অজ্ঞাত রোগের চিকিৎসা সম্ভব: ডা. শক্তি রঞ্জন

ঢাকা: চিকিৎসকের আন্তরিকতা ও উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তির সমন্বয়ে অজ্ঞাত রোগের চিকিৎসা সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক, গবেষক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শক্তি রঞ্জন পাল।   

ডা. শক্তি রঞ্জন পাল একজন স্বনামধন্য ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।

তিনি ৪০ বছরেরও বেশি সময় থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। ২০০০ সাল থেকে তিনি থাইল্যান্ডের ব্যাংকক হাসপাতালের হেডকোয়ার্টারে একমাত্র বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন।   

ডা. শক্তি বিভিন্ন জটিল অজ্ঞাত রোগ, মাল্টি-সিস্টেম ডিজিজ, ডায়াবেটিস, মেটাবলিক সিনড্রোম, অ্যান্টি-এজিং এবং পুরুষের যৌন স্বাস্থ্য নিরাময়ের ক্ষেত্রে তার দক্ষতার জন্য সুপরিচিত।  

ডা. শক্তি রঞ্জন পাল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। এসময় তিনি বাংকক হাসপাতালের বাংলাদেশের ধানমন্ডির শাখায় বাংলানিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বিভিন্ন ধরনের অজ্ঞাত রোগ এবং চিকিৎসা বিষয়ে কথা বলেন। তার সাক্ষাতকারের চুম্বক অংশটুকু বাংলানিউজের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।  

ডা. শক্তি রঞ্জন পাল বলেন, কারও একটা অসুখ আছে, কিন্তু রোগটা কি এখনো তা নির্ণয় করা হয় নাই বা করা যায় নাই এমন অসুখকেই সাধারণত অজ্ঞাত বা অজানা রোগ বলা হয়ে থাকে। সাধারণত এক মাসের কম সময়ে আমরা কখনও অজ্ঞাত রোগ বলি না। যখন দেখা যায়, দুই মাস, ছয় মাস, এক/দুই বছর হয়ে গেছে কিছুই ধরা পড়ছে না, তখন এটাকে আমরা অজ্ঞাত রোগ বলি।

তিনি আরও বলেন, বিষয়টা একটু জটিল। যেমন, কোনো একটা লোকের জ্বর হয়েছে, তার জ্বর একমাস দুই মাস কিংবা টানা ছয়মাস ধরেই চলছে। এর মধ্যে সেই জ্বরের রোগী চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ক্যান্সার এমন অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেছে বিভিন্ন ল্যাবে। কিন্তু রোগটা কি কেউ শনাক্ত করতে পারছে না। চিকিৎসক তাকে কিছু ঔষধ দিচ্ছেন খেতে, হয়তো শেষে কোন রোগ ধরতে না পেরে রোগীকে এন্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু রোগীর জ্বর আর কমছে না। দেখা যাচ্ছে, কিছুদিন হয়তো জ্বর কমছে আবার জ্বর ফিরে আসছে। তখন এই জ্বরটাকে আমরা বলবো undiagnosed fever ফিভার (অজ্ঞাত জ্বর)। অর্থাৎ জ্বরের উৎস কি তা জানা যাচ্ছেনা। সুতরাং এটা একটা অজ্ঞাত রোগ। এই রোগীকে যদি আমরা ভালোভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করি, তাহলে একটা সময় হয়তো রোগটা ধরা পড়বে। তখনো তার চিকিৎসাও করা যাবে।  

নিজের একজন রোগীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৫ বছরের ঢাকার একজন ছেলের জ্বর হচ্ছে, সাথে রক্তশূন্যতাও দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি সে শুকিয়ে যাচ্ছে। তখন এই ছেলেটিকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কিছুদিন তাকে প্যারাসিটামল এবং এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো হলো। তাতেও সে সুস্থ হচ্ছে না, কিছুদিন পর পর আবার জ্বর চলে আসছে। তার স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছে, সে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে পড়াশোনাও বন্ধ করে দিতে হয়। একজন ডাক্তারের পরামর্শক্রমে ঢাকার একটি ভালো হাসপাতালে তার বোন ম্যারো পরীক্ষা করা হয়। এরপর তারা বাচ্চাটির লিউকেমিয়া (ব্লাড ক্যান্সার) হয়েছে বলে সনাক্ত করেন এবং কেমোথেরাপি দিতে বলেন। এতে বাচ্চাটির বাবা-মা ভয় পেয়ে যান। তখন বাচ্চাটির বাবা-মা আমার সাথে যোগাযোগ করলে আমি তাদেরকে সম্ভব হলে ব্যাংককের হাসপাতালে আসতে বলি। আমি বাচ্চাটির বাবা মাকে বলি, যে স্লাইড দিয়ে পরীক্ষা করে ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছিল, সেই স্লাইডটিও সঙ্গে নিয়ে আসতে। তারা স্লাইডটি নিয়ে যায়।

তখন আমি সেই স্লাইডটি আমাদের ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠাই। পরীক্ষার পর তারা আমাকে বলে যে না, এখানে ক্যান্সারের কোনো কিছু নেই। এর আগে কোনো ডায়াগনোসিস ছিল না, পরে যেটা করল সেটাও প্রশ্নের সম্মুখীন। তখন আমি আমাদের হাসপাতালে একজন রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞকে বললাম, আবার একটি ফ্রেশ বোন ম্যারো করতে। ফ্রেশ বোন ম্যারো করার পরেও তারা বলল কোনও ক্যান্সার নেই। তবে তার বোন ম্যারোতে আমরা অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখতে পাচ্ছি, যেটা আমাদের এই ল্যাবে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। এটা হয়তো কোনো ট্রপিকাল ডিজিস যেটা আমরা জানি না। ওইখানে ট্রপিক্যাল মেডিসিনের একটি হাসপাতাল রয়েছে, সেখানে স্যাম্পল পাঠানো হলো। তখন ট্রপিক্যাল মেডিসিন হাসপাতাল পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলো বাচ্চাটির কালা জ্বর। তখন আমি সেই হাসপাতালকে বলি তোমরা কি এটা নিশ্চিত, কারণ কালা জ্বর বাংলাদেশ থেকে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। তারা বললো, নিশ্চিত। কালা জ্বরের ওষুধ থাইল্যান্ডের নেই, এমনকি বাংলাদেশেও নেই। তখন আমরা ভারত থেকে ওষুধ এনে আমাদের হাসপাতালেই ছেলেটির চিকিৎসা করি। ছয় সপ্তাহ চিকিৎসার পর আস্তে আস্তে তার জ্বর চলে যায় এবং সে সুস্থ হয়ে ওঠে। এই ছেলেটা ৭/৮ মাস ধরে একটি অজ্ঞাত জ্বরে কষ্ট পাচ্ছিল। পরিশেষে একটা রোগ ধরা পড়ল যেটা চিকিৎসা যোগ্য। এরকম অজ্ঞাত রোগ আরও অনেক রয়েছে। শুধু জ্বর নয়, হাড়ের অসুখ, কিংবা প্যানিক এটাকের রোগীকে হার্ট অ্যাটাক শনাক্ত করে হার্ট এটাকের ওষুধ খাওয়ানোর উদাহরণও আছে। আমি সব সময় বলি, আজকে যেটা অজ্ঞাত রোগ হিসেবে রয়েছে, কাল সেটা হয়তো চিহ্নিত করা যাবে এবং চিকিৎসাও সম্ভব।  

 

আমাদের দেশে অজ্ঞাত রোগের চিকিৎসার ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশে চিকিৎসকরা অনেক বেশি চাপে থাকেন। প্রতিদিন তাদের হাসপাতালে এবং চেম্বারে অনেক রোগী দেখতে হয়, তাই অনেক ক্ষেত্রেই ইচ্ছা থাকলেও রোগীকে তারা বেশি সময় দিতে পারেন না। পাশাপাশি এখানে উন্মতমানের প্রযুক্তিগত বিষয়টিও আছে। আবার অনেক চিকিৎসক যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অজ্ঞাত রোগের ক্ষেত্রেও সেই বিষয়কেই প্রাধান্য দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে থাকেন। ফলে রোগটি অজ্ঞাতই থেকে যায়।  

অজ্ঞাত রোগের চিকিৎসা বিষয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, অজ্ঞাত রোগের চিকিৎসায় দুইটি বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত রোগিটিকে চিকিৎসকদের অনেক গভীর এবং আন্তরিকতার সাথে, অনেক সময় নিয়ে ধৈর্য ধরে দেখতে হবে। একবারে না হলে দ্বিতীয় তৃতীয় কিংবা চতুর্থবার চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয়ত সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডায়াগনোসিস করা। অনেক ক্ষেত্রে আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য অনেক বেশি হলে রোগীর আর্থিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটা করাতে চায় না। অনেকেই হৃদরোগ ডায়াবেটিস, ক্যান্সার কিংবা অন্যান্য রোগ বিষয়ে কথা বলে, কিন্তু অজ্ঞাত রোগ বিষয়ে কেউ কোনও কথা বলতে চায় না, লিখতে চায় না। মনে হয় অজ্ঞাত রোগ বিষয়ে কারো কোন কিছু করার নাই। তাই আমি এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করি। আমি বলি এই ধরনের রোগে কেউ আক্রান্ত হলে কখনোই আশা ছেড়ে দেবেন না। যেহেতু এত কিছুর পরেও রোগী মারা যায়নি, বড় কোন রোগও ধরা পড়েনি, তাই বলা যায় অজ্ঞাত রোগ অনেক বেশি বিপজ্জনক নয়, এই আশাটা জীবিত রাখতে হবে। প্রথম এবং দ্বিতীয়বার যেহেতু কোনো কিছু শনাক্ত হয়নি, তাই এই বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের কাছে যেতে হবে। আমার কাছে আসতে হবে বিষয়টি এমন নয়, ভারত বা সিঙ্গাপুরেও যেতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে কোন জায়গায় টেকনোলজি উন্নত সেই বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে। কারণ বর্তমান সময়ের উন্নত মানের চিকিৎসা প্রযুক্তি (টেকনোলজি) ছাড়া শুধু ডাক্তারের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। যদি ভালো চিকিৎসক এবং  উন্নত মানের টেকনোলজি থাকে তাহলে হয়তো একটা সময় রোগের সমাধান আসবে। শতভাগ না হলেও দেখা যায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সমাধান হয়ে যায়। আমার ডাটা অনুযায়ী আমি দেখেছি ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভালো সমাধান পাওয়া যায়। ৫ শতাংশ লোকের আংশিক সমাধান হয়, আর বাকি ৫ শতাংশ ফেইলর হয়। ৯৫ সফলতা অনেক ভালো বলা যায়। ৫ শতাংশ ফেইলর এটা যে কোন অপারেশনের ক্ষেত্রেও হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০২৩
আরকেআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।