মেহেরপুর: মাত্র ১ জন মেডিকেল অফিসার( চিকিৎসক) দিয়ে চলছে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবসহ বিভিন্ন কারনে ভেঙ্গে পড়েছে এ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির চিকিৎসা সেবা।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ আনোয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ২০ টি মেডিকেল অফিসারের পদ থাকলেও এখন মাত্র আমি রয়েছি। বাকিরা বিভিন্ন কারণে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ের ৯ টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ৯ জন মেডিকেল অফিসারের পদও দীর্ঘদিন শুন্য। হাসপাতালের উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেসথেসিয়া), জুনিয়র কনঃ সার্জারী, জুনিয়র কন, মেডিসিন, জুনিয়র কনঃ গাইনী ,জুনিয়র কনঃ শিশু, জুনিয়র কনঃ চক্ষু, জুনিয়র কনঃ অর্থো, জুনিয়র কনঃ কার্ডিও, জুনিয়র কনঃ ইএনটি, আবাসিক মেডিকেল অফিসার, ৫ জন মেডিকেল অফিসার, সহকারী ডেন্টাল সার্জন,১২ জন সহকারী সার্জনের পদ শুন্য রয়েছে এখানে সব গুলো কনসালট্যান্টর পদই খালি রয়েছে।
এছাড়া ২০ জন ডাক্তারের পদ শূণ্য রয়েছে। হাসপাতালে তৃতীয় শ্রেণীর পদ রয়েছে ৯৫ জন। সেখানে কর্মরত রয়েছে ৭৪ জন, পদ শূণ্য রয়েছে ২১ টি। এছাড়া চতুর্ত শ্রেণীর মুঞ্জুরীকৃত ৩০ টি পদের বিপরীতে ২০ জন কর্মরত থাকলেও শূণ্য রয়েছে ১০ টি পদ।
এদিকে হাসপাতালে সুপেয় পানির অভাবে মানুষের মাঝে হাহাকার শুরু হয়েছে সেই কবে থেকে। আজ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ষাটের দশকে নির্মিত এ পুরানো হাসপাতালটি এখন পুরোটাই জরাজীর্ণ। যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়ে প্রাণ হারাতে পারেন ডাক্তার,কর্মকর্তা,কর্মচারীসহ চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।
চিকিৎসকদের বসার স্থান,আবাসিক সমস্যা,ঝূকিপূর্ণ ভবণ,বৈদ্যতিক ওয়ারিং, আর চিকিৎসক সংকটে রুগ্ন হয়ে পড়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি।
পরিত্যাক্ত ঘোষিত ভবনে রোগী ও চিকিৎসকদের জীবনের ঝূঁকি নিয়ে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।
প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির অবস্থা সবচেয়ে করুন।
ভবনের একাধিক স্থানের ছাদের পলেস্তারা খসে খসে পড়েছে। ফুটো হয়ে পানি পড়ে ছাদ থেকে। ঝূকি কমাতে কক্ষ ছেড়ে বারান্দায় এসে চিকিৎসা সেবা দিতে হয় ডাক্তারদের।
রোগীর চাপ সামলাতে ইউনিয়ন সাবসেন্টারগুলো থেকে পালাক্রমে চিকিৎসক এনে কিছুটা সামাল দেওয়া হয়।
জরুরী প্রসূতি সেবা দেওয়ার মত চিকিৎসক এখানে থাকলেও মান সম্মত ওটির অভাবে প্রসূতি সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। ওটি দেওয়ালে লোনা ধরা ভাঙা, নেই ওটি টেবিল ও লাইট। ছাদ দিয়ে পানি চুঁয়ে পড়ে। এসি নেই। এখানে চিকিৎসকরা এসে থাকতে চায়না। ভাল বাসা না থাকার কারণে চিকিৎসকদের বাইরে বাসা নিয়ে থাকতে হয়।
গাংনী বাজরের হোটেল ব্যবসায়ী মিনার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, গাংনী উপজেলা বিভিন্ন গ্রামে প্রতিদিন মারামারি, কাটাকাটি করে প্রচুর পরিমান রোগী আসে। এছাড়া সড়ক দূর্ঘটনায় আহত নিহত হয় বহু লোক।
এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিকিৎসা না হওয়ায় অধিকাংশ রোগীদের যেতে হয় কুষ্টিয়া বা রাজশাহীর মত বড় যায়গায়।
হাসপাতাল বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা চিকিৎসকদের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকার ফলে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন। ওই সময় কয়েকটি ক্লিনিকের কিছু চিহ্নিত দালালরা তাদের নানা ধরণের প্রলোভন ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ক্লিনিকগুলোতে টেনে নিয়ে যায়।
গাংনী উপজেলার আমতৈল মানিকদিয়া থেকে আসা হাতভাঙ্গা রোগী মালেকা বাসু ও তার স্বামী আসারুল ইসলামের সাথে কথা হলে তারা বাংলানিউজকে জানান, সকালে এক্স-রে করতে আসি। কিন্ত শুনলাম এখানে এক্স-রে হয়না। তাই ফিরে যাচ্ছি। এখানে এক্ এক্স মেশিনটি ডাক্তারদের দুর্নীতির কারনে বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানালেন কয়েকজন।
জানা গেছে গাংনী হাসপাতালের আরএমও ডাঃ আনোওয়ারুল ইসলামের ভাই ডাঃ আবু তাহের সিদ্দীকের তাহের ক্লিনিকের কাছে এক্স-রে করার জন্যই অত্যন্ত কৌশলে এ মেশিনটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে ৩১ শয্যার গাংনী হাসপাতালকে ৫০ শয্যায় উন্নতি করা হয়েছে। প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৬ সালে হাসপাতালের নতুন ভবনের কাজ শুরু হলেও চাঁদাবাজির কারনে তা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে প্রায় ৬ বছর যাবৎ।
অথচ হাসপাতালের ঠিকাদার মাত্র ৪০ শতাংস কাজ করে ৮০ শতা টংশ টাকা তুলে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ ও গাংনী হাসপাতালের ডাক্তারদের ম্যানেজ করে।
গাংনী হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা ভেঙ্গে পড়লেও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ হাসান আলী ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ আনোওয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কীমের প্রায় ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে।
৪ সদস্যের তদন্ত টিম এ দুর্নীতির তদন্ত করে ইতোমধ্যে গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আব্দুস সালামেমর কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। তদন্তে ১২ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ ও বিভিন্ন দুর্নীতিসহ নানা অনিয়ম ধরা পড়েছে বলে জানা গেছে।
স্থানীরা বাংলানিউজকে জানান, ডাঃ হাসান আলী ও ডাঃ আনোওয়ারুল ইসলাম প্রায় ২০ বছর যাবৎ এ হাসপাতালটিতে কর্মরত রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়রা নানা ধরণের অনিয়মের অভিযোগ তুলে দরখাস্ত করলেও অজ্ঞাত কারণে তাদের বদলি হয়না। কয়েকবার ডাঃ হাসান আলী বদলি হলেও কয়েক মাসের মধ্যে আবারো হাসপাতালটিতে ফিরে আসেন।
এছাড়া হাসপাতালের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য বরাদ্দকরা অর্থসহ বিভিন্ন সময়ে বরাদ্দ করা অর্থের কোন কাজ না করেই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও আরএমও মিলে ভাগবাটোয়ারা করে নেই বলে অভিযোগ করেছেন গাংনীর চৌগাছা গ্রামের বুলু মন্ডল।
এ নিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন কর্তৃপক্ষের কাছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৪ঘন্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১২
সম্পাদনা: সোহেলুর রহমান, নিউজরুম এডিটর