অধিকাংশ নারীই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্তনের স্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কায় ভোগেন। অনেকেই ভাবেন স্তনে হালকা ব্যথা বা চাকা মানেই ক্যানসার, আবার কেউ কেউ উপসর্গকে একেবারেই গুরুত্ব দেন না।
স্তন ক্যানসার মূলত স্তনের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার কারণে হয়। এই কোষগুলো টিউমারে রূপ নিতে পারে, যা শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করে। ক্যানসারের ধরন ও পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা ভিন্ন হতে পারে। তবে রোগটি যদি প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে, তাহলে চিকিৎসার সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
প্রাথমিক শনাক্তকরণ এই রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিয়মিত স্ক্রিনিং, চিকিৎসকের পরামর্শ এবং নিজের শরীরের পরিবর্তনের প্রতি সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। ২০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতিমাসে একবার স্তন স্ব-পরীক্ষা করার অভ্যাস গড়ে তুললে স্তনে কোনো অস্বাভাবিকতা দ্রুত চিহ্নিত করা সম্ভব। যদি কোনো চাকা, ব্যথা বা পরিবর্তন অনুভূত হয়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
৪০ বছর বয়সের পর নারীদের জন্য ম্যামোগ্রাম পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এক ধরনের এক্স-রে, যা স্তনে ক্ষুদ্র টিউমার বা অন্য কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়তে সাহায্য করে। যাদের পরিবারে স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে আরও আগে থেকেই এই পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এছাড়া এমআরআই স্ক্রিনিংও বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের জন্য কার্যকর হতে পারে। পাশাপাশি, অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে ক্লিনিক্যাল স্তন পরীক্ষা বছরে অন্তত একবার করানো উচিত।
স্তন ক্যানসারের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যেমন—স্তনে চাকা অনুভূত হওয়া, ত্বকের অস্বাভাবিক পরিবর্তন, স্তনের বোঁটা থেকে তরল বের হওয়া বা স্তনের আকার-গঠনে পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়। সচেতনতার কারণে অনেকেই নিজেদের শারীরিক পরিবর্তন দ্রুত বুঝতে পারেন, যা সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণে সহায়তা করে এবং জীবন বাঁচাতে পারে।
তবে স্তন ক্যানসার কেবল শারীরিক কষ্টই দেয় না, এটি রোগীকে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে তোলে। রোগীরা প্রায়শই একাকিত্ব ও হতাশার মধ্যে ভোগেন। তাই তাদের জন্য পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতাল ও সংগঠন মানসিক সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করে থাকে, যা রোগীদের চিকিৎসার পথকে আরও সহজ করে তোলে।
বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। প্রতি বছর অসংখ্য নারী এতে আক্রান্ত হন এবং প্রাণ হারান। নারীদের ক্যানসারের মধ্যে স্তন ক্যানসারই সবচেয়ে বেশি। সচেতনতার অভাব, সামাজিক ট্যাবু, লজ্জা এবং গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসা সুবিধার সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে রোগ ধরা পড়ে না। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে প্রায় ৯০ শতাংশ রোগী সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধি, সময়মতো পরীক্ষা এবং সারাদেশে আধুনিক স্ক্রিনিং সুবিধা নিশ্চিত করাই এখন জরুরি।
সচেতনতা, প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং দ্রুত চিকিৎসা এই তিনটি বিষয় স্তন ক্যানসারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তাই নিজের এবং প্রিয়জনের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সময়মতো পরীক্ষা করা এবং সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব। সমাজে সচেতনতার মাধ্যমেই এই রোগের ঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক: ডা. ফেরদৌস শাহরিয়ার সাঈদ, সিনিয়র কনসালট্যান্ট অ্যান্ড কো-অর্ডিনেটর, মেডিকেল অনকোলজি
এভারকেয়ার হসপিটাল, ঢাকা
এএটি