ফরিদপুর: অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে বাধ্য হয়ে ফরিদপুরের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে এসে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন রোগীরা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের পাশাপাশি নিয়মিত চিকিৎসক, ওষুধ ও সেবিকার সঠিক সেবা না পাওয়াও নিত্যদিনের ব্যাপার।
সরেজমিনে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, সমাজের দরিদ্র মানুষগুলো অর্থ সংকটে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে না পেরে বাধ্য হয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালে প্রবেশ করলেই দুর্গন্ধে নাকে রুমাল বাধতে হয়। নামমাত্র ঝাড়ু দেওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে আবর্জনা পড়ে আছে হাসপাতালের এখানে-সেখানে। পানি দিয়ে না ধোয়ার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ আমলে একটি মাত্র ভবনে ১০ শয্যার হাসপাতালটি চালু হয়। স্বাধীনতার পরে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া না লাগলেও বেশ কয়েকবার সংস্কারের পর বর্তমানে ৫টি ভবনে কার্যক্রম চলছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। এর মধ্যে ১তলা ভবন তিনটি, ২তলা ১টি ও ১টি ৩তলা ভবন রয়েছে।
১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাতপাতাল হলেও সে অনুযায়ী জনবল নেই, তার ওপর বাড়তি রোগীর চাপ রয়েছে সরকারি এ হাসপাতালটিতে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহের কথা বললেও রোগীরা বলছেন উল্টোটা।
পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ১১ শয্যার ওয়ার্ডে রোগী ২৫ জন। তাদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত মাত্র ১ জন সেবিকা। ১৪ জন রোগীকে মেঝোতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। হাসপাতালে থেকে দেওয়া তিন বেলার সরকারি খাবারের মান নিয়েও সন্তুষ্ট নন রোগীরা। এর মধ্যে যারা মেঝেতে থাকছেন, তারা খাবারও পান না।
শিশু ওয়ার্ডে দুটি টেস্ট টিউব যন্ত্র থাকলেও দীর্ঘদিন অকেজো পড়ে আছে। পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি ফরিদপুর শহরতলীর চুঙ্গীর মোড় এলাকার আবদুল হালিম মোল্যা বলেন, লিভারের সমস্যা নিয়ে দু’দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। হাসপাতাল থেকে শুধু গ্যাস্ট্রির ওষুধ দিচ্ছে। বাকি ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে।
নগরকান্দার মাঝারদিয়ার রুহুল আমীন বলেন, তলপেটে ব্যথা নিয়ে এক সপ্তাহ আগে ভর্তি হয়েছি। গত বুধবার অ্যাপেন্ডিস এর অপারেশন হয়েছে। অপারেশন করতে টাকা লাগে নাই। তবে ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। সমস্যা মনে করলে সঠিক সময়ে নার্স ডেকে পাওয়া যায় না। যাও বা আসেন, রুক্ষ আচরণ তাদের।
করিম মাতুব্বরের ডাঙ্গির রোগী খাদিজা বেগম বলেন, হাসপাতালের বাথরুম অপরিস্কার-অপরিচ্ছন্ন। নিতান্ত দায় থেকে এটি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি। খাবার পানির কোনো সুব্যবস্থা নেই। তবে ফরিদপুর শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ভালো থাকায় এখানে বিদ্যুতের কোনো সমস্যা নেই।
এতো বড় হাসপাতালটিতে একটি মাত্র অপারেশন থিয়েটার। যা একবারেই অপ্রতুল। অপারেশনের সিরিয়াল পেতেও দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতে হয় রোগীদের।
হাসপাতালের প্রধান সহকারী জাকির হোসেন বলেন, ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে ২০০ বেড ও হাসপাতালের মেঝেতে কমপক্ষে আরো অর্ধশতাধিক রোগীর সেবা দেওয়া হয়। অথচ হাসপাতালে সেই ১০০ শয্যার লোকবল রয়েছে। যে কারণে অধিক রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়।
তিনি বলেন, ১০০ শয্যার লোকবল দিয়েই চলছে প্রায়্ই ২৫০ রোগীর চিকিৎসা। তাছাড়া হাসপাতালে সার্জারি, চক্ষু, স্কিন বিভাগ না থাকায় রোগীরা সমস্যায় পড়েন। ডেপুটেশনের মাধ্যমে এসব বিভাগে ১০/১২ জন লোকবল নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। বর্তমানে ২৮ জন চিকিৎসক, ৪২ জন সেবিকা ও ৪র্থ শ্রেণীর ২০ জনের পদ থাকলেও ৭টি পদশূন্য। ঝাড়ুদার ও সুইপারের ১৫ জনের জায়গায় রয়েছেন ৭ জন।
হাসপাতালের স্টোর কিপার গিয়াসউদ্দিন বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে ১০৫ ধরনের ওষুধ রয়েছে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের ৫টি ওষুধের মধ্যে তিনটি হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। বাকি দু’টি বাইরে থেকে কিনতে হয়। তিনি বলেন, হাসপাতালে ভ্যাকসিন ও ইনজেকশন সরবরাহ নেই। এছাড়া আউটডোরে ১৫/১৬ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়।
রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে চিকিৎসকদের সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত অফিস করার কথা থাকলেও প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখার কারণে অধিকাংশ চিকিৎসক দুপুর ১টার আগেই হাসপাতাল থেকে চলে যান।
হাসপাতালের প্রায় প্রত্যেক চিকিৎসকই প্রাইভেট ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করেন। এর মধ্যে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ উষা রঞ্জন চক্রবর্তী জেনারেল হাসপাতালের বাইরে নুর ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কার্ডিওলজির ওবায়দুর রহমান আফতাব ডায়াগনস্টিক, সার্জারির সৈয়দ আসিফ আফতাব ডায়াগনস্টিক, গাইনি বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ রায় পরিচর্যা প্রাইভেট হাসপাতাল, শিশু বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ হিল সাদ আরোগ্য সদন, কামাল আহম্মেদ কল্যাণ ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ অধিকাংশ চিকিৎসক ফরিদপুরের বিভিন্ন ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করেন।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারেও রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। দীর্ঘ সময় সিরিয়াল দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। পুরোনো মেশিনপত্র হওয়ায় তার প্রতি আস্থা পাওয়া যায় না। তাই অধিকাংশ রোগী আশেপাশের প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা করান।
এছাড়া অফিস চলাকালে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের (এমআর) ডাক্তারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার নিয়ম না থাকলেও সারা দিনই তাদের দৌরাত্ম্যে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন রোগীরা।
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, সরকারি আইন উপেক্ষা করে তারা হাসপাতালে অফিস সময়ে ডাক্তারদের চেম্বারে ভিড় করছেন। তাদের দাপটে ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না রোগীরা।
এছাড়া সকালে আউটডোরে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা নারী ও শিশুদের প্রতিদিনই লম্বা লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে টিকিট নিতে হচেছ।
নারী ও শিশুদের জন্য আউটডোরের মাত্র একটি টিকিট কাউন্টার থাকায় বিভিন্ন উপজেলার দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাড়িয়ে ভোগান্তির শিকার হয়। বেলা সোয়া ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত টিকিট কাউন্টারে প্রচণ্ড ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সেখানে ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে মায়েরা টিকিট কাটতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছিলেন।
শহরের আলীপুর এলাকার সীমা, লক্ষীপুরের পারুল, শহরতলীর মুন্সীবাজারের আলাউদ্দিন,খাবাসপুর এলাকার হৃদরোগী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাইয়ুমসহ কথা হয় বেশ কয়েকজন অপেক্ষমাণ রোগীর সাথে। তাদের সকলেরই অভিযোগ, হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ডাক্তারদের সময় মতো কক্ষে পাওয়া যায় না।
এদিকে বিনামূল্যে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়ার কথা থাকলেও নামমাত্র কিছু ওষুধ নিয়েই বিদায় হতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালের ওষুধ বিতরণ বিভাগে গিয়ে তালিকায় এন্টিবায়টিকসহ বিভিন্ন ওষুধের নাম লেখা দেখা গেছে। কিন্তু রোগীদের অভিযোগ, তাদের দেওয়া হচ্ছে প্যারাসিটামল, হিস্টাসিন ও এন্টাসিডসহ কম দামের কয়েকটি ওষুধ।
শহরের ভাটিলক্ষীপুর এলাকার তারেক নামের এক রোগী অভিযোগ করে বলেন, এমআরদের পরামর্শে চিকিৎকরা পার্সেন্টেজের বিনিময়ে এমন সব ওষুধের নাম লিখে রোগীদের হাতে ধরিয়ে দেন, যে সকল ওষুধ হাসপাতালে পাওয়া যায় না।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার (আরএমও) বাসস্থানটি পরিত্যক্ত হওয়ায় সেখানে তিনি থাকেন না। শহরে বাড়ি ভাড়া করে থাকেন তিনি। হাসপাতালের আবাসিক তিনতলা ভবনটিতে অ্যানেসথিসিয়া বিভাগের চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান একাই থাকেন জানান আরএমও ডা. আফজাল হোসেন।
ফরিদপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. সিরাজুল হক তালুকদার বলেন, ১০০ শয্যার লোকবল থাকলেও ২শ’রও বেশি রোগী সব সময় থাকে। তাই অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে অন্য রোগীদের সমস্যায় পড়তে হয়। তবে আমাদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা থাকে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের পরিবেশ ঠিক রাখতে যে পরিমাণ সুইপার ও ঝাড়ুদার দরকার তা না থাকায় কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে এগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে। শিগগিরই এসবের সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করি।
সিভিল সার্জন বলেন, হাসপাতালের নির্ধারিত ডিউটি শেষ করে চিকিৎসকরা প্রাইভেটভাবে প্র্যাকটিক করতে পারবেন। তবে কেউ হাসপাতাল থেকে আগে চলে গেলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৪