শিক্ষা ও সংস্কৃতির শহর ময়মনসিংহে এখন চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দাপট। শহরের চরপাড়া, ব্রাহ্মপল্লী, ভাটিকাশর ও বাঘমারা এলাকায় গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে নামসর্বস্ব ও নিম্নমানের অসংখ্য ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
সম্প্রতি শহরের ক্লিনিকপাড়ার বেপরোয়া এই চিকিৎসা বাণিজ্য ও অনিয়মের নানা দিক অনুসন্ধান করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান। পড়ুন তৃতীয় পর্ব
ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ শহরের সানকিপাড়া হেলথ অফিসারের গলিতে থাকেন এক বেসরকারি চাকুরে। একমাত্র ছেলের পেটের ব্যথা। সপ্তাহ দু’য়েক আগে চিকিৎসা করাতে যান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বহির্বিভাগে টিকিট সংগ্রহের পর ভালো-মন্দ খোঁজ নেবার অজুহাতে ভদ্রবেশে এগিয়ে এলেন ছদ্মবেশী এক দালাল।
হাসপাতালে রোগীর সুচিকিৎসা হবে না- সুকৌশলে মস্তিস্ক ধোলাই করে নিয়ে গেলেন হাসপাতালেরই এক চিকিৎসকের কাছে। দালালতন্ত্রে বিশ্বাসী ওই চিকিৎসক মাসিক কমিশন পাওয়া একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে যাবার পরার্মশ দিলেন তাকে। সেখানে শিশুটির অস্ত্রোপাচার করা হলো। তিনদিনের ব্যবধানে চিকিৎসক, দালাল আর ক্লিনিক মালিক অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে হাতিয়ে নিলেন ১৬ হাজার টাকা!
শুধু ওই শিশুটি বা তার বাবাই নয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৬ জেলার মানুষের চিকিৎসা সেবার প্রধান প্রতিষ্ঠান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে দালালদের প্রতিনিয়ত এমন প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে আরও অসংখ্য রোগীকে। এ হাসপাতালে এখন চরম উদ্বেগ আর আতঙ্কের একটি নাম ‘রোগী ধরা। ’
খোদ মমেক হাসপাতাল জুড়ে রয়েছে কমপক্ষে চার শতাধিক পেশাদার রোগী দালাল। স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবার অঙ্গনের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে রয়েছে তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক। হাসপাতালের এক শ্রেণীর চিকিৎসকদের সঙ্গেও রয়েছে যোগসাজশ।
জেলাব্যাপী প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত দিন থেকে রাত অবধি রোগী ধরার কাজেই ব্যস্ত থাকেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দালালরা। কম টাকায় চিকিৎসা সেবার কথা বললেও দালালদের কমিশনের টাকাও আদায় করা হয় আবার রোগীর কাছ থেকেই।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, মমেক হাসপাতালের সামনের ও আশেপাশের ছোট-বড় ক্লিনিক, প্যাথলজি, ক্লিনিকের দালালদের খপ্পড়ে পড়ে হাসপাতালের কাছে এসেও সেখানকার সেবা নিতে পারেন না রোগীরা। তবে চড়া দামে ক্লিনিকে সেবা পেতে গিয়েও তাদের হতে হয় প্রতারিত।
হাসপাতালের সামনে ও আশপাশের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন ধরনের দালাল রয়েছে। এক শ্রেণীর দালাল আছে- যারা গ্রামগঞ্জের ফার্মেসি এমনকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও মার্কেটিং করে রোগী আনে।
আরেক শ্রেণী আছে- যারা মমেক হাসপাতালে ভর্তি হতে আসা রোগীদের সুচিকিৎসা ও ভালো চিকিৎসকের কথা বলে বিভিন্ন ক্লিনিক-বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।
তাদের আবার রয়েছে রিকশাওয়ালা দালালও। যারা রেলষ্টেশন ও বাসস্টপ থেকে অসুস্থ রোগীদের মমেক সংলগ্ন চরপাড়ার বিভিন্ন ক্লিনিক-প্যাথলজি ও বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।
অন্য শ্রেণীর দালালরা হলেন ভিআইপি। তাদের মধ্যে রয়েছেন অনেক চিকিৎসকও। সব মিলিয়ে এ দালালের সংখ্যাটা কমপক্ষে চার শতাধিক।
মমেক হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে সপ্তাহ দু’য়েক সরেজমিনে ঘুরে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগ এবং হাসপাতালের গেটে প্রায় আড়াই শতাধিক দালাল আছে। জরুরি বিভাগের ‘সর্দার’ তারাই!
তার সিন্ডিকেটে সদস্য কম করে হলেও অর্ধ শতাধিক। তাদের কাজ জরুরি বিভাগের সামনে থেকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে কিংবা ভুলিয়ে বালিয়ে আশেপাশের ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া।
সূত্র মতে, হাসপাতালের সামনের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধের দোকানে ‘রোগী ধরা’ কাজে নেতৃত্বে আছেন বিল্লাল ও সাগর নামের দু’জন। সাগরের বাবাও আবার ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের চিহ্নিত পকেটমার!
সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে রোগী ধরে ক্লিনিকে নিয়ে যাবার সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন সাগর (৩৫)। পরে ছাড়া পেয়ে আবারও পূর্ণোদ্যমে শুরু করেছেন এ ব্যবসা।
হাসপাতাল গেটে দালালদের উৎপাতের কথা বর্ণনা করে এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক জানান, একবার গ্রাম থেকে এক রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তবে দালাল তাকে বাগে নিয়ে রওয়ানা দিলেন এক ক্লিনিকের দিকে। কিন্তু মাঝপথে ওই রোগী বললেন-তিনি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাবেন না।
‘কিন্তু দালালের মাথা নষ্ট! মারপিট শুরু করলেন রোগীকে। পরে রোগীর চিৎকার-চেচামেচিতে স্থানীয় লোকজন তাকে দালালের খপ্পড় থেকে উদ্ধার করেন। ’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, রাউন্ডআপ থেকে প্রতিদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ক্লিনিক প্যাথলজিতে রোগী পাঠান চিকিৎসকরা। বিনিময়ে তারা কমিশন পান!
এভাবে দৈনিক বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা নিশ্চিত করা হয় বলে অভিযোগ করেন তারা।
ভুক্তভুক্তদের অভিযোগ, হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের আঁতাত আছে। হাসপাতাল কেন্দ্রিক রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করে চলেছে।
আর নিজেদের দেওয়া ক্লিনিক-ডায়াগনোস্টিক ছাড়া প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট হাসপাতালে গ্রহণ করা হয় না বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে প্যাথলজি ব্যবসায় জড়িতরাই পরবর্তীতে বেসরকারি হাসপাতাল খুলেছে। রোগীদের সরকারি হাসপাতালের বদলে নিজস্ব ক্লিনিকেই চিকিৎসা করাতে জোর প্রচারণা চালানো হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অত্যাধুনিক সরকারি হাসপাতালের সামনে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ‘রোগী ধরে’ বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে রোগী প্রতি ৪০ শতাংশ টাকা কমিশন পান দালালরা। যা কোন কোন ক্ষেত্রে আরও বেশিও হয়ে থাকে। মাসে ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়।
ব্যাপক অভিযোগের ভিত্তিতে এবং দালালদের মাধ্যমে পাওয়া রোগীদের ভুলচিকিৎসা, অপচিকিৎসা ও মৃত্যুজনিত কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হাঙ্গামা হলে অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এতে কয়েকজন দালাল ধরাও পড়েন। কিন্তু খুব দ্রুত বের হয়ে ফের আধিপত্য বিস্তার করে বসেন তারা।
শফিকুল ইসলাম নামে এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, রাউন্ড আপের সময় জুনিয়ররা নির্দিষ্ট প্যাথলজি-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম বলে দেন। অথচ হাসপাতালেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার উন্নত যন্ত্রপাতি আছে।
সূত্র জানায়, হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভিন্ন উন্নত যন্ত্রপাতি থাকলেও তা চালু হয়নি। তাই বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্য বাড়ছে। এতে উৎসাহিত বাড়ছে অপচিকিৎসা, যা রোগীর চিকিৎসা ব্যয়কেও দ্বিগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
‘জনউদ্যোগে’র আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, দালালদের ব্যবহার করে চিকিৎসা বাণিজ্য চলছে। যা খুবই উদ্বেগের। এ অপতৎপরতা রোধে হাসপাতাল ও প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
তবে দালালদের উৎপাতের জন্য বিভিন্ন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ও এক শ্রেণীর চিকিৎসকদের দায়ী করেন বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. এ কে এম ওয়ালিউল্লাহ।
তিনি বলেন, দালালরা বেশ শক্তিশালী। ক্লিনিক মালিকরাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। একজন রোগী ধরতে পারলেই একেকজন দালাল ১ থেকে ২ হাজার টাকা পাচ্ছে। প্রতিদিন সবার চোখের সামনেই প্রকাশ্যে দালালদের খপ্পরে পড়ে অসংখ্য রোগী ফতুর হচ্ছেন।
প্রশাসনের সাধারণ রোগীদের সতর্ক করতে সচেতনতামূলক বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন প্রবীণ এ চিকিৎসক।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ফসিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মতিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেক সময় হাসপাতালের চিকিৎসকরা দালালদের শনাক্ত করতে পারেন না। দালালদের অপতৎপরতা বন্ধে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ’
দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করেছেন ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোস্তফা কামালও। তিনি বলেন, দালালদের তালিকা আমাদের হাতে নেই।
মমেক হাসপাতালকে ঘিরে দালালদের অপতৎপরতা বন্ধে হাসপাতালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৩ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৫
এমএ
** হাসপাতালের সামনেই ক্লিনিক-প্যাথলজির জঞ্জাল
** সড়কজুড়ে রোগী ঠকানো বাণিজ্য!
স্বাস্থ্য
চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা-৩
৪ শতাধিক পেশাদার দালাল, আতঙ্ক ‘রোগী ধরা’
এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।