ঢাকা: মরদেহ রাখার ফ্রিজই মরা; এটা কেমন কথা! প্রযুক্তিনির্ভর এই ডিজিটাল যুগে এত বড় সরকারি হাসপাতালের (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকের কলেজ হাসপাতাল) ফ্রিজই যদি মরা থাকে, তাহলে কেমনে কী হয়!’
এমনভাবে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্নবোধক বাক্য উচ্চারণ করে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করেন মরদেহের সঙ্গে আসা বরিশালের সিদ্দিকুর রহমান। তার বড় ভাই লতিফুর রহমান কেরানীগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশের পেছন পেছন তিনিও মরদেহের সঙ্গে এসেছেন মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে। মর্গের ডোমরা বললেন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজ আর লাশ কাটা যাবে না। আগামীকাল লাশ কাটার পর ময়না তদন্ত হবে। এই বিরতির সময়ে লাশ যাতে না পচে, তার জন্য বরফের মধ্যে রাখতে হবে।
এমন অবস্থায় সিদ্দিকুর রহমান তার মৃত ভাইয়ের মরদেহ ভালো রাখতে বরফের জন্য এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। কোথায় পাওয়া যাবে বরফ!
সিদ্দিকুর জানান, মরদেহের ময়না তদন্ত শেষ হলে বরিশালের পিরোজপুরে নিয়ে দাফন করা হবে। এতে অনেক সময় লেগে যাবে। ফলে মরদেহ বরফে রাখা ছাড়া উপায় নেই। বরফ কোথায় পাওয়া যাবে- বিভিন্নজনের কাছে এমন প্রশ্ন করতে থাকেন তিনি। এক সময় মর্গ থেকে বাইরে বেরিয়ে যান বরফের সন্ধানে।
এ বিষয়ে মিটপোর্ড হাসপাতালের মর্গ সহকারী শ্যামল চন্দ্র দাশ বাংলানিউজকে বলেন, মরদেহের ফ্রিজটি অনেক দিন ধরেই নষ্ট হয়ে আছে। ছয় মাসের বেশি সময় হবে মরদেহ রাখার এই ফ্রিজটি নষ্ট হয়ে রয়েছে। মরদেহ নিয়ে শুধু তাদের স্বজনেরাই নন, আমরা মর্গের লোকজনও বিপদে রয়েছি।
তিনি বলেন, আগে ফ্রিজটা যখন ভালো ছিল, তখন আমাদের কষ্ট কম হতো। মরদেহ আনা মাত্রই ফ্রিজের মধ্যে রেখে দিতাম। এই ফ্রিজটিতে ছয়টি করে মোট ১২টি মরদেহ রাখা যেতো। ফ্রিজটি নষ্ট হওয়ার পর থেকে মরদেহ নিয়ে আসা লোকজনের পাশাপাশি আমাদেরও যেন কষ্টের শেষ নেই!
শ্যামল চন্দ্র হতাশ কণ্ঠে বলেন, কখনো কখনো একাধিক মরদেহ বরফ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়। ফলে অনেক রাতে বাসায় ফিরতে হয়!
তিনি আরো বলেন, ফ্রিজটি নষ্ট হওয়ার পর থেকে অন্তত ছয় থেকে সাতটি আবেদনপত্র দিয়েছি ঊর্ধ্বতন স্যারদের কাছে। পরে তারা সংশ্লিষ্ট মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে দিয়েছেন। মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানটি আজ নয়, কাল করে করে সময় পার করছে। অথচ প্রতিদিনই একাধিক মরদেহ সংরক্ষণ করে রাখতে হয় মর্গের মধ্যে।
বুড়িগঙ্গা নদীর উপর দিয়ে যাওয়া বাবুবাজার ব্রিজ সংলগ্ন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালটির ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চক্রবর্তী বাংলানিউজকে বলেন, মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ফ্রিজটি প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন এটি মেরামত করতে গেলে ব্যয় অনেক বেশি হবে। ফলে, বিষয়টি ঊর্ধ্বতনরা বিবেচনা করছেন।
তবে মর্গের জন্য শিগগিরই ফ্রিজ প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
১৮ জুন (বৃহস্পতিবার) হাসপাতাল মর্গে গিয়ে দেখা যায়, একজন পুরুষ ও একজন বৃদ্ধার মরদেহ আধা কাটা অবস্থায় রয়েছে। ভেতরে প্রচণ্ড পচা গন্ধ। যারা মরদেহ কাটেন, তারাও যেন অধৈর্য হয়ে যাচ্ছেন মরদেহ কাটতে গিয়ে।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েকদিনের পুরনো মরদেহ থেকে এই পচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এতে মরদেহ কাটতে গিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের সমস্যাতেও পড়ছেন।
এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল জাকির হাসান ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ দিলীপ কুমার ধরের কাছে মরদেহ রাখার ফ্রিজটি মেরামত ব্যয় সাশ্রয়ী হবে না বলে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। এরপর থেকে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই। চিঠি পর্যন্তই বিষয়টি যেন ফ্রিজ হয়ে রয়েছে!
রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর কোল ঘেঁষে বাবুবাজার ব্রিজ সংলগ্ন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটিতে (মিটফোর্ড) প্রতিদিনই অনেক রোগী আসেন চিকিৎসা সেবা নিতে।
চিকিৎসা নিতে আসার রোগীরা দাবি করেন, বাংলাদেশ যেমনি দ্রুত প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনিভাবে যেন সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবাও উন্নত হয়। আর এ থেকে হাসপাতালের মর্গও যেন বাদ না যায়!
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৫
এনএইচএফ/এবি