ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

‘চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মানই হবে আমাদের জাতীয় মান’

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৭ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৬
‘চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মানই হবে আমাদের জাতীয় মান’

ঢাকা: হাসপাতালের প্রতিটি পরতে পরতে তার আন্তরিকতার ছোঁয়া। ছাদ থেকে মেঝে, এ দেয়াল থেকে ও-দেয়াল পুরোটাই পরিপাটি।

মাঝে যতশত যন্ত্রপাতি তার সবগুলোই অত্যাধুনিক। যার কোনওটা সুইজারল্যান্ড কোনওটা বৃটেন, কোনওটা আমেরিকা, আবার কোনওটা সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড থেকে আনা। যেই যন্ত্রই হোক সেটি হবে সেই পণ্যের সবসেরা ব্র্যান্ড, হাসপাতালের যেই উপকরণই হোক মানে-গুনে তা হবে সর্বোন্নত।

ডাঃ এনামুর রহমান বললেন, সবাই বলে আন্তর্জাতিক মানের কথা, আমি আসলে আন্তর্জাতিক মানটিকেই আমাদের জাতীয় মানে পরিণত করতে চাই। দেশে অন্তত একটি হলেও হাসপাতাল থাকুক যার মান হবে এমন।

‘দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, এনাম মেডিকেল তেমনি একটি হাসপাতালে পরিণত হচ্ছে,’ বললেন তিনি।

হচ্ছে কেনো! এখনো হয়নি! বাংলানিউজের এই বিষ্ময়ে তিনি বলেন, উন্নত মানের কোনও সীমারেখা নেই। আজ যা উন্নত, কালই তা পুরাতন। ফলে আমাদের মানোন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা প্রতিনিয়ত, প্রতিদিনই করে চলতে হয়।

এনামুর রহমান একজন চিকিৎসা উদ্যোক্তা আর একই সঙ্গে একজন জনপ্রতিনিধি। সাভারে আওয়ামী লীগের হয়ে সংসদ সদস্য। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন চিকিৎসক।  

ডাঃ এনামুর রহমান আর তার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে নতুন করে চিনিয়ে দেওয়ার কিছু নেই এ কারণে যে, ২০১৩ সালের এপ্রিলে ভয়াবহ রানাপ্লাজা ধসে সাভারে যখন মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে তখন এই এনাম মেডিকেলে চিকিৎসা হয় শত শত আহত শ্রমিকের।

এনামুর রহমান বলেন, সে ছিলো এক মর্মান্তিক পরিস্থিতি। আমাদের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব ছিলো তার পুরোটাই করেছি। জাতীয় প্রয়োজনে এমনভাবে কাজে লাগতে পারাই ছিলো এনাম মেডিকেলের জন্য সবচেয়ে বড় সার্থকতা।

দেশে যেনো এমন একটি ঘটনাও আর না ঘটে, সেই কামনা করে মানবিক গুনে গুনান্বিত মানুষটি বললেন, সে সময় সুবিধাবাদী অনেক দেশই বাংলাদেশকে সহায়তার নাম করে ঢুকে পড়তে চেয়েছিলো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমরা পুর্ণাঙ্গ নিশ্চয়তায় সকল অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম চিকিৎসা সেবা নিয়ে।

দিনে দিনে আরও আধুনিক হয়ে ওঠা হাসপাতালটি ঘুরে ঘুরে বাংলানিউজ টিমকে দেখাচ্ছিলেন এনামুর রহমান। মাটির নিচে গড়ে তোলা নতুন ক্যান্সার ইউনিট, যা ১২ফুট পুরু দেয়াল আর রেডিয়েশন মুক্তরাখার অন্যান্য ব্যবস্থা নিয়ে তৈরি হচ্ছে। দেখালেন অত্যাধুনিক ল্যাব, প্যাথলজি, আইসিইউ, সিসিইউ, পেডিয়াট্রিক ইউনিট। চিকিৎসা সেবার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করতে এতটুকু কমতি নেই এনাম মেডিকেলে।

এনামুর বলেন, আচ্ছা বলুনতো মানুষ সিঙ্গাপুর ব্যাঙ্কক কেন যায় তাদের চিকিৎসার জন্য? স্রেফ এই জন্যইতো যে, সেখানে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। তাহলে আমরা যদি সেই চিকৎসা ব্যবস্থাকেই এখানে নিশ্চিত করতে পারি তাহলেই তো আন্তর্জাতিক মানটি হয়ে উঠবে আমাদের জাতীয় মান।

আরও বললেন, দেশকে আমরা সিঙ্গাপুরে পাঠাবো না, সিঙ্গাপুরকেই বরং দেশে নিয়ে আসবো।

ঘুরতে ঘুরতে বাংলানিউজ টিমটি যখন পেডিয়াট্রিক সেন্টারে যায়, সেখানে দেখা যায় অন্তত সাতটি নবজাতককে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই শিশুগুলো কোনও না কোনও জটিলতায় পড়েছে। এনামুর রহমান বলেন, এখানে শিশুদের চিকিৎসার মানে থাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার। সবচেয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি, আর দেশের সেরা চিকিৎসকদের এখানে রাখা হয়েছে। তারাই এই চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করেন।

সেখানেই কথা হচ্ছিলো প্রখ্যাত মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহীন আখতারের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, এনামুর রহমান এমন একজন ব্যক্তি যার কাছে যখন যা প্রয়োজন তা চেয়ে আমরা পেয়ে যাই। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি চাওয়ার আগেই দিয়ে দেন। এতে আমরা এই ইউনিটটিকে সবচেয়ে আধুনিক আর সবচেয়ে কার্যকর করে গড়ে তুলতে পেরেছি আর চিকিৎসা সেবা দিতে পারছি।

এনামুর রহমান বলেন, চিকিৎসাটিই মূল কথা। আমি নিজেও একজন চিকিৎসক, সুতরাং আমি জানি কি প্রয়োজন। আর সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রয়োজনের মাত্রা ও বিশেষত্ব পাল্টায়, সুতরাং নিজেদের এগিয়ে রাখতে হলে চিকিৎসা বিজ্ঞান ও পদ্ধতিতে নতুন নতুন যে উন্নয়ন ঘটছে তা দেখে বুঝে ও জেনে প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এনাম মেডিকেলে আমি সেটাই করি।

প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়েও এখান থেকে মুনাফা লাভের আশা করছেন না চিকিৎসক এনামুর রহমান। তিনি বলেন, আমি এই হাসপাতালকে মোটেই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখি না। কিছু আয় অবশ্যই আসে। কিন্তু যতটুকু আয় আসে তার সঙ্গে আরও যোগ করে তা বিনিয়োগ করি। তাতেই আজ এই সুনাম ও হাসপাতাল হিসেবে আধুনিক হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে কথা হচ্ছিলো এনাম মেডিকেল কলেজের বর্তমান অ্যাডভাইজার ও প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল মান্নান শিকদারের সঙ্গে। একসময় তিনি ছিলেন এনামুর রহমানেরও শিক্ষক।

অধ্যাপক মান্নান বলছিলেন, এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে এনামুরের কাছে আমরা যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। বরং বলা চলে, যা চাই তার চেয়ে বেশিই পাই।

তিনি বলেন, আমরা চাই একটা রুপার চামচ, তিনি নিয়ে হাজির হন একটা সোনার চামচ।

মেডিকেল কলেজের আধুনিক ক্লাসরুম, লেকচার থিয়েটার, মাল্টি-পারপাস হলগুলো ঘুরে দেখাতে দেখাতে সে কথাই বলছিলেন এনামুর রহমান। বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে যেমনটা দেখে আসি সেগুলোই এখানে বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। আর সে কারণেই স্যার এত মুগ্ধ। তবে মেডিকেল কলেজকে অত্যন্ত উন্নত মানে পৌঁছাতে অধ্যাপক আবদুল মান্নানের অবদানের কথাই বললেন ডাঃ এনামুর।  

তিনি বলেন, যখনই কোনও ভালো শিক্ষক পেয়ে যান, স্যার আমাকে বলেন নিয়ে নাও। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে নিয়ে নেই। আমি চাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে দেশের সেরা সেরা শিক্ষকরা এনাম মেডিকেল কলেজে পড়াবেন।

দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে এনামই সেরা সে কথা এখন সর্বজন স্বীকৃত। যোগ্যতার সকল মাপকাঠিতে এই কলেজ সবচেয়ে এগিয়ে। নিজস্ব ক্যাম্পাস, নিজস্ব হস্টেল, নিজস্ব শিক্ষক দিয়ে পরিচালিত এই কলেজের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যাও তেমন অনেক। চলতি বছরে এখানে ভর্তি হয়েছে ১৫৫ জন শিক্ষার্থী। তবে এর ক্যাপাসিটি বছরে ২৫০ জনের। সরকার প্রতিবছরই ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষার্থী বাড়ানোর সুযোগ দিচ্ছে এই মেডিকেল কলেজকে। যেখানে অন্যান্য মেডিকেল কলেজগুলো শিক্ষার্থীই পাচ্ছে না। সেখানে এনাম মেডিকেল কলেজে কোটা পূরণ হয়ে যায় অনায়াসেই।

আর শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আসছে ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, শ্রিলংকা থেকেও। সবশেষ ব্যাচেও ভর্তি হয়েছে বিদেশি ৬০ জন শিক্ষার্থী।

এনামুর রহমান বলেন, শিক্ষার মান ও পাঠদানের পরিবেশ দিয়েই আমরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পেরেছি।

আর বিদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেলো এনাম মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়ে তারা ধন্য।

গোটা হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোরকে দেখা গেলো কর্মব্যস্ত। কিন্তু কোথাও নেই কোনও হৈ-চৈ, হুল্লোড়। ডাঃ এনামুর বলেন, কোনও রোগী এসে যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেই আমরা। ফলে হৈ-হুল্লোড়টা কম।
     
হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে আরও দেখা গেলো এখানকার আউটডোরের ভীর সরকারি হাসপাতালকেও হার মানাবে। সে প্রসঙ্গে এনামুর রহমান বলেন, সেবা পাচ্ছেন বলেই রোগীরা এখানে আসেন। আমরা সেবাটিকেই সবচেয়ে প্রাধান্য দেই। আর পাশাপাশি চিকিৎসা খরচও অপেক্ষাকৃত কম।

এনামুর বলেন, অনেক হাসপাতালে বাইরের শান-শওকতটা বেশি থাকে, তারা হাসপাতালকে সুসজ্জিত করতে বেশি ব্যয় করে। আমরা সেটা করি না। আমরা রোগীর ও দর্শনাথীর সাচ্ছন্দটা নিশ্চিত হতে যতটুকু প্রয়োজন তাই করি। রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ করি।

ঘোরাঘুরির সময় এখানে সেখানে থামতে হলো কারণ অনেক রোগীর চিকিৎসা বিল কমানোর আবদার। কেউ লিফটের সামনে, কেউ করিডোরে এনামুর রহমানকে থামিয়ে হয় মওকুফ চাইছেন, নয়তো কিছু ছাড়।

কাউকেই হতাশ করেননি তিনি।

বাংলানিউজকে বললেন, এমনই হয়। আমরা ভালো চিকিৎসা দিচ্ছি জেনে অনেক গরীব মানুষও এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। তখন তাদের দিকটি দেখতেই হয়।

হয়তো এটাই আপনার ব্যাপক জনপ্রিয়তার একটি কারণ! বাংলানিউজের এই মন্তব্যে মুখে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে সামনে গেলেন এনামুর রহমান। সেখানেও দেখা গেলো চিকিৎসা খরচ মওকুফের জন্য বিল হাতে দাঁড়িয়ে আরেকজন।

ডাঃ এনামুর তাতে সই করে বিল কমিয়ে দিলেন।

লিফটে উঠতে উঠতে বললেন, যাও ১০ হাজার টাকা কমিয়ে দিলাম। অননি ব্যক্তিটি নুয়ে কদমবুসি করলেন এনামুর রহমানকে।

অনেকের মাঝে কিছুটা বিব্রত হলেও, মনে হলো এমন কদমবুসি তাকে প্রায়শঃই নিতে হয়।

বাংলানিউজ টিমের সদস্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কতই আর কমানো হলো, কিন্তু যার কমলো তার জন্য কিন্তু এটা অনেক বড় উপকার!

বাংলাদেশ সময় ১৭০১ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।