ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

সঠিক ধারণার অভাবে বাড়ছে রক্তরোগীর সংখ্যা

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৮
সঠিক ধারণার অভাবে বাড়ছে রক্তরোগীর সংখ্যা প্রতীকী

ঢাকা: থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া ও ব্লাড ক্যান্সারের মতো রক্তের তিনটি জটিল রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশে। এর প্রধান কারণ রোগ সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ রোগের কারণে মৃত্যু ঘটছে। এ ধরনের রক্তরোগের সমন্বিত চিকিৎসাসেবায় দেশে নেই কোনো বিশেষয়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান।

রক্তরোগ বিশেষজ্ঞদের তথ্য মতে, থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। রক্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লোহিত রক্তকণিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন।

যা রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ করে কোষগুলোকে সক্রিয় রাখে। কিন্তু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ লোহিত রক্তকণা উৎপাদন হয় না। বাবা অথবা মা, কিংবা বাবা-মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে বংশানুক্রমে এ রোগটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়।

থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১৪ জনে একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক। প্রতিবছর প্রায় ১০৪০ জন শিশু বিটাথ্যালাসেমিয়া মেজর এবং প্রায় ৬৪৪৩ জন শিশু হিমোগ্লোবিন ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বেঁচে থাকতে এ রোগীদেরকে নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয়। যা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল অন্যদিকে কষ্টসাধ্যও বটে।

রক্তের আরেকটি বংশানুক্রমিক জিনগত অনিরাময়যোগ্য রোগের নাম হিমোফিলিয়া। এ রোগ হলে রক্ত জমাট বাঁধতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াব্যহত হয়। শরীরে কোথাও কেটে গেলে সহজে  রক্তপাত বন্ধ হয় না। কারণ, রক্ত জমাট বাধার উপাদান রক্তে কম থাকে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি ১০ হাজার জনে একজন হিমোফিলিয়ায় রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে প্রায় ১৬ হাজার হিমোফিলিয়া রোগী রয়েছে। আর রোগটি সাধারণত পুরুষদেরই দেখা যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তে ফ্যাক্টর-৮ এর ঘাটতির কারণে হিমোফিলিয়া-এ এবং ফ্যাক্টর-৯ এর অভাবে হিমোফেলিয়া-বি’তে আক্রান্ত হয়। হিমোফেলিয়া হলে রোগীর রক্তপাত বেড়ে যায়। মহিলাদের মাসিকে দীর্ঘদিন ধরে রক্ত ঝরা, সময়ে সময়ে নাক বা দাঁত দিয়ে রক্ত বের হওয়া, দাঁতের অপারেশনের পর প্রচুর রক্তপাত হওয়া এবং প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া -এসবই হিমোফিলিয়া রোগের লক্ষণ।

চিকিৎসকদের মতে, ৮৫ শতাংশ রোগীর হিমোফেলিয়া-এ এবং ১৫ শতাংশ রোগীর হিমোফেলিয়া-বি হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্তদের সবসময় সচেতনতার সঙ্গে চলাফেরা করা উচিৎ। যেন আঘাতে রক্তক্ষরণ না ঘটে। হলে রোগীকে রক্ত দিতে হবে। কারণ রক্ত থেকে তৈরি ‘ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা’ এ রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম। তবে ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা তৈরিতে অনেক রক্ত ও বেশ সময় লাগে। সঙ্গে প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল।

রক্তের আরেকটি মরণব্যধির নাম রক্তকোষের ক্যান্সার বা ব্লাড ক্যান্সার। ঠিক কী কারণে ব্লাড ক্যান্সার হয় সে বিষয়টি এখনো বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট নন। তবে রেডিয়েশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল বা কারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক, পেস্টিসাইড বা কীটনাশক, ভেজাল খাবার ও খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার, হেয়ার ডাই ও কিছু প্রসাধনীর ব্যবহার, লুব্রিকেন্টস, বার্নিশ, কেমোথেরাপি ব্যবহারের ইতিহাস ও কিছু জেনেটিক অসুখ থাকলে ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসারে ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া মূলত দুই ধরনের। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া ও ক্রনিক লিউকেমিয়া। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া বেশি মারাত্মক। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে রোগী বেশি দিন বাঁচতে পারে না। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া আবার দুই ধরনের- অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া (এএলএল) এবং  অ্যাকিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া (এএমএল)।  

এ ধরনের রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। শুধু কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করলে দুই থেকে আড়াই বছর চিকিৎসা নিতে হয়। অনেক সময় বিশেষ বোন ম্যারোট্রান্সপ্লান্টেশন বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে হয়। ক্রনিক লিউকেমিয়ারও প্রকারভেদে চিকিৎসার ধরন ভিন্ন ভিন্ন। তবে সঠিক চিকিৎসা নিয়ে অনেক দিন ভালোভাবে জীবনযাপন করা যায়।

রক্তরোগের উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা প্রদানে ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে ল্যাব ওয়ান ফাউন্ডেশন ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ল্যাব ফাউন্ডেশনের প্রধান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সালাহউদ্দিন শাহ বাংলানিউজকে বলেন, অসহায় ও দরিদ্র রোগীদের স্বল্পমূল্যে উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা প্রদানে এ প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। দরিদ্রদের চিকিৎসায় অনুদানের ব্যবস্থা রয়েছে। ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রায় ২ হাজার ৫০০ নিবন্ধিত রোগী আছে। যারা স্বল্প মূল্যে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন।

এছাড়া সব ধরনের রক্তরোগের সমন্বিত চিকিৎসা প্রদানে সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় (বাসা-৮, রোড -১২, সেক্টর-১৪, উত্তরা) ল্যাব ওয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব হেমাটোলজি অ্যান্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে এটিকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে আরো প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। অর্থ সংগ্রহে আগামী ৩ বছরের মধ্যে ৩ লাখ মাটির ব্যাংক, ৩ লাখ আন্তর্জাতিক সদস্য এবং ৩ লাখ দেশীয় সদস্য সংগ্রহের কাজ চলছে। প্রাপ্ত অর্থ রোগীদের চিকিৎসা, রোগ সম্পর্কে রিসার্চ এবং প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার কাজে ব্যয় করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৮
এমএএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।