সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এক অভিযান চালিয়ে বিষয়টির প্রমাণ পায়। অভিযানে কর্মকর্তারা দেখতে পান- হাসপাতালটিতে বেড প্রাপ্তি, সিরিয়াল ভেঙে ইসিজি ও ইকো করা, ডেথ সার্টিফিকেট নেওয়ার সময় বিভিন্ন হারে ঘুষ দিতে হয়।
হাসপাতালটির বহির্বিভাগ এবং ভর্তিকৃত রোগীদের অধিকাংশের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে হয়, অধিকাংশ সময়ে রোগীদের রশিদ না দিয়ে সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিজেদের পকেটে টাকা ভরেন। এ কাজে হাসপাতালটির টেকনিশিয়ান আনিসুর রহমান ও রমজান আলী জড়িত। তাদের দুইজনেরই পাইকপাড়ায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে বলে জানা গেছে।
হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে বছরের পর বছর কর্মরত আছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দবির উদ্দিন। এখানে মহিলা ও শিশু অপারেশনের রোগী থাকেন। অপারেশনের সময়ে প্রকারভেদে প্রতিজনের ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। দবির উদ্দিন হাসপাতালের উল্টোদিকে ঢাকা ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে রোগীদের বাধ্য করেন এবং ওই ফার্মেসি থেকে কমিশন পান বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাসপাতালের অনিয়মে আরেকটি জায়গা এনজিওক্যাথল্যাব বিভাগ। এমন কোনো অনিয়ম নেই যা এখানে হয় না। হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০-৬০ জন রোগীর এনজিওগ্রাম করা হয়। এর মধ্যে ১৫-২০ জন রোগীর রিং পরানো হয়। পেসমেকার স্থাপন করা হয় ৪-৫ জন রোগীর। রোগীর এনজিওগ্রাম এবং রিং পরাবার জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় সেটি ‘ডাই’ নামে পরিচিত। একজন রোগীর ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ডাই প্রয়োজন হয় তার চেয়ে অধিক পরিমাণ রোগীদের দিয়ে কেনানো হয়। প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ডাই বাইরের ফার্মেসিতে নগদ টাকায় বিক্রি করা হয়। একজন রোগীর জন্য ১০০ মিলি লিটার প্রয়োজন হলে কমপক্ষে ৩০০ মিলি লিটার কিনতে বাধ্য করা হয়। প্রতি ১০০ মিলি ডাইয়ের মূল্য ১৮০০-২০০০ টাকা। ডাই পাচারের এই সিন্ডিকেটের হোতা ক্যাথল্যাব ইনচার্জ টেকনিশিয়ান তারিকুল ইসলাম লিটন।
লিটনের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির আরো সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। রোগীর রিং পরাবার সময় রিং ছাড়াও রোগীকে গাইডার, বেলুন ওয়ার কিনতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে হাসপাতাল সামান্য পরিমাণ সরবরাহ করলেও অধিকাংশ রোগীদের কিনতে হয়। রিং এবং উল্লেখিত সামগ্রীর বিক্রয় প্রতিনিধিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারিকুল ইসলাম লিটনের কাছে তারা জিম্মি। তার পছন্দের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে রিং এবং উল্লেখিত সামগ্রী কিনতে বাধ্য করেন তিনি। প্রতি রিং বাবদ তাকে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাকে টাকা দেয় না সেই প্রতিষ্ঠানের রিং লাগাতে তিনি নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন। লিটন এই হাসপাতালে ‘বড় লোক’ কর্মচারী হিসেবে পরিচিত।
এদিকে ক্যাথল্যাবে এনজিওগ্রাম শেষে রোগীকে বেডে পৌঁছাতেও হয়রানির শিকার হতে হয়। বেডে যেতে রোগীর স্বজনকে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বকশিস দিতে হয় যারা রোগীকে বেডে পৌছে দেন তাদের। রিং পরানো রোগীদের শিট খুলতেও ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা বকশিস দিতে হয়। ক্যাথল্যাবের ওয়ার্ড বয় আব্দুল গফুর মিয়া ও টেবিল বয় বদিউল আলম টুকু এ সিন্ডিকেটের হোতা।
দুদক সূত্র জানায়, হৃদরোগ চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তাদের হটলাইন-১০৬-এ প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ আসে। এরপর দুদক মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরীর নির্দেশে চার সদস্যের একটি টিম অভিযান চালায়। টিমে নেতৃত্ব দেন দুদকের সহকারী পরিচালক ফারজানা ইয়াসমিন।
অনিয়মের বিষয়ে হাসপাতাল প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছে বলে জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের ওই সহকারী পরিচালক।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৮
এমএএম/এমজেএফ