ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

এক চিকিৎসকে চলছে শেবামেকের ফরেনসিক বিভাগ!

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯
এক চিকিৎসকে চলছে শেবামেকের ফরেনসিক বিভাগ!

বরিশাল: দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বৃহৎ ও নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবামেক) হাসপাতাল। অথচ মাত্র এক জন চিকিৎসক দিয়েই চলছে এই হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সব কার্যক্রম।

অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের পাঠদান থেকে শুরু করে ভিকটিমের মেডিক্যাল পরীক্ষা ও ময়নাতদন্তের কার্যক্রম, সবই করে থাকেন এই একজন চিকিৎসকই। ফলে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত তো হচ্ছেই, পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর নিষ্পত্তিতেও বিলম্ব হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শেবামেক হাসপাতালের প্রশাসনিক শাখা সূত্রে জানা গেছে, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে এক জন অধ্যাপক, এক জন সহযোগী অধ্যাপক, দু’জন সহকারী অধ্যাপক, তিন জন লেকচারার ও এক জন মেডিক্যাল অফিসারসহ ৮ জনের পদ রয়েছে। তবে এর অনুকূলে বর্তমানে ফরেনসিক বিভাগে রয়েছেন মাত্র এক জন প্রভাষক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই একজন প্রভাষকই কলেজের এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার কাজ করছেন। যদিও মাঝে-মধ্যে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অন্য বিভাগের শিক্ষকরা তাকে সহয়তা করেন। তবে শিক্ষার্থীদের সার্বিক ভবিষ্যত ওই একজন প্রভাষকের ওপরই নির্ভর করছে।

এর বাইরে এ বিভাগে আদালত থেকে পাঠানো বিভিন্ন ধর্ষণ মামলায় ভিকটিমের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ছেলে-মেয়েদের বয়স নির্ধারণসহ আরও অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। একইসঙ্গে এক জন চিকিৎসকের অধীনেই মর্গে আসা মরদেহগুলোর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়ে থাকে।  

ফলে একজন চিকিৎসকের পক্ষে একসঙ্গে এতগুলো কাজ আলাদাভাবে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তাই প্রায়ই বিভিন্ন কাজে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়।  

অন্যদিকে এই একজন চিকিৎসক যদি ছুটিতে যান, তাহলে পড়তে হয় আরও বিড়ম্বনায়। যদিও ভিকটিমের মেডিক্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে আলাদা ও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে এ বিভাগটিতে।

শেবামেক হাসপাতালের শিক্ষক ও চিকিৎসক নেতারা বলছেন, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসকদের বাইরে প্র্যাকটিসের কোনো সুযোগ থাকে না। এরপর আবার এই বিভাগটির দায়িত্বরতদের ওপর সামাজিক চাপও থাকে। নিরাপত্তাজনিত একটি বিষয়ও থাকে। এর মধ্যে আবার সাক্ষী দিতে আদালতেও যেতে হয়। যা কিনা অবসরের পরও কয়েক বছর করতে হয়। কিন্তু সেই হিসেবে আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না তারা।  

‘তাই সার্বিক দিক বিবেচেনা করেই হয়তো এ বিষয়ে পড়াশোনা করে কেউ আসতে চাচ্ছেন না। আবার মেডিক্যালে বাধ্যতামূলক কোনো বিষয় নেই যে তাকে গ্রেড মার্ক পেয়ে নির্ধারিত সাবজেক্টেই পড়তে হবে। তাই এটা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়। ’

চিকিৎসক নেতাদের মতে, যদি কর্মরত চিকিৎসকদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নন প্র্যাকটিস সম্মানী দেওয়া হয় এবং চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো (৬৫ বছর) হয়, তাহলে ফরেনসিক মেডিসিনসহ বেসিক সাবজেক্টগুলোতে শিক্ষার্থী ও চিকিৎকদের আগ্রহ বাড়বে। এতে করে এখনকার মতো সবাই ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টের দিকে ঝুঁকবে না।

শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা বলছেন, এক জন শিক্ষক থাকার কারণে ফরেনসিক মেডিসিনের বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান অর্জন করাটা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু শেবামেক হাসপাতালেই নয়, গোটা দেশেই ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ে প্রতিনিয়ত শিক্ষক সংকট থাকছেই। গোটা দেশে ৩৪-৩৫টি মেডিক্যাল কলেজ থাকলেও অধ্যাপক রয়েছেন মাত্র চার জন। পারিপার্শ্বিক কারণসহ সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় সিনিয়রদের যেমন আগ্রহ ছিল না এই বিষয়ে পড়াশোনা করার, আর এখন বাস্তবতা দেখে আমরাও আগ্রহ হারাচ্ছি।

এ বিষয়ে শেবামেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. বাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বরিশালে এমনিতেই চিকিৎসকরা থাকতে চাচ্ছেন না। এর কারণ আগে খুঁজে বের করা উচিত। এছাড়া ফরেনসিক মেডিসিনসহ বেসিক সাবজেক্টগুলোতে চিকিৎসকরা কম ঝুঁকছেন।  

‘আমি মনে করি, বেসিক সাবজেক্টগুলোতে আলাদা কোনো সম্মানী দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর করা হোক। ’

মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সৈয়দ মাকসেমুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। এ সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে সারা বাংলাদেশেই ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসকের সংকট রয়েছে।  

‘কারণ ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ে আসা চিকিৎসকের অনেক ঝামেলা পোহাতে হলেও সেই অনুযায়ী বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। তাই অনেকেই ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসক হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। ’

বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইসমাইল হোসেন মন্টু বাংলানিউজকে বলেন, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগটি আইন-আদালত অর্থাৎ বিচার বিভাগের সঙ্গে জড়িত। এই বিভাগের মাধ্যমে ধর্ষণ-হত্যার মতো ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়। আর ওই ধরনের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফরেনসিক রিপোর্ট প্রয়োজন হয়। যদি এ বিভাগে চিকিৎসক সংকট থাকে, তবে সেক্ষেত্রে সব কাজেই বিলম্ব দেখা দিতে পারে।

বাংলা‌দেশ সময়: ০৯৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯
এমএস/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।