ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

দ্বিতীয়বার করোনায় আক্রান্ত বরিশালের ডা. শিহাব

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০২ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০২০
দ্বিতীয়বার করোনায় আক্রান্ত বরিশালের ডা. শিহাব

বরিশাল: মানুষের সেবায় নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে করতে হঠাৎ একদিন নিজের শরীরে ধরা পরে করোনা (কোভিড-১৯) ভাইরাসের উপস্থিতি। এরপর নিজেকে আইসোলেশনে রেখে কখনো হাসপাতালে কখনো বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। সেরেও উঠেছেন অল্প সময়ের মধ্যে। তারপর আবার কর্মস্থলে যোগদানের মধ্য দিয়ে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।

করোনা থেকে আরোগ্য লাভ করা একজন সৌভাগ্যবান হিসেবে সিদ্ধান্ত নেন অসুস্থ রোগীকে প্লাজমা দেওয়ার। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একজন মাকে বাঁচাতে ছুটে যান এবং প্লাজমা দিয়েও আসেন।

আসার পর ৩০ মে আবার নমুনা দিয়ে টেস্ট করিয়ে ২ জুন জানতে পারেন তিনি পুনরায় করোনায় আক্রান্ত। তবে হাল ছাড়েননি ওই সেবক, স্বপ্ন দেখছেন সাহস নিয়েই আগামীর পথচলার।

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মুহাম্মাদ শিহাব উদ্দিন। তিনি বুধবার (৩ মে) দুপুরে বাংলানিউজকে মোবাইলে জানান মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ে সুস্থ হয়ে আবার কাজে ফেরার কথা।

তিনি জানান, গত ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইমার্জেন্সি ইভেনিং ডিউটিরত অবস্থায় জানতে পারেন সেখানকার একজন নার্স, একজন পিয়ন ও জেনারেল ওয়ার্ডে মারামারি করে ভর্তি হওয়া এক রোগীর কোভিড-১৯ রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।

তিনি বলেন, হঠাৎ এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত খবরে পুরো হসপিটাল যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাথা কাজ করছিল না। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। তখনও ইমার্জেন্সি রোগী রিসিভ করছিলাম। তবে দ্রততম সময়ের মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল লকডাউন ঘোষণা করেন।  

‘এরপরই মাথা ঠাণ্ডা করে প্ল্যান করলাম কীভাবে নিজেকে আর নিজের ফ্যামিলিকে রক্ষা করা যায়। কারণ বাসায় বৃদ্ধ মা-বাবা ভাইয়া-ভাবি থাকেন। ’

ডা. শিহাব বলেন, যেহেতু তখনো টেস্ট হয়নি তাই নিশ্চিত হতে পারছিলাম না যে শরীরে করোনা আছে কিনা! আর থাকলে সেটি ইতোমধ্যে বাসার সবার মধ্যে ছড়িয়ে গেছে, নয়তো একত্রে থাকলে সবাই আক্রান্ত হবে- এটা নিয়ে ভাবছিলাম। কিন্তু কোথায় থাকা যায় এই চিন্তা করতে করতেই ভাইয়াকে ফোনে সব বললাম। তিনি বুঝতে পারেন। রাতের মধ্যেই বরিশাল নগরের বাসায় আমার জন্য আলাদা ফ্লোরে হাফ কমপ্লিট একটা ফ্ল্যাটে কোনোভাবে থাকার ব্যবস্থা করেন।

‘পরের দিন সকালে যথাযথ প্রটেকশন নিয়ে বাসায় যাই এবং আমার জন্য রেডি করে রাখা উপরের ফ্লোরের সেই রুমে ঢুকি। শুরু হয়ে গেলো আমার হোম আইসোলেশন। ’

তিনি বলেন, কিছু জটিলতার কারণে দেরি হলেও পরবর্তীসময়ে স্যারদের সহযোগিতায় ১৮ এপ্রিল আমার বাসায় এসে স্যাম্পল নিয়ে যায়, ২০ এপ্রিল আমি জানতে পারি আমার কোভিড-১৯ পজিটিভ। পজিটিভ রিপোর্টের জন্য যদিও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম তবু্ও পজিটিভ শোনার পর কিছু সময়ের জন্য নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। যাই হোক নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে এরপর কি করা উচিত তাই ভাবছিলাম।  

‘আলাদা রুম হলেও বাসায় থাকাটা পরিবারের জন্য রিস্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে ভেবে ২৩ এপ্রিল সকালে শের-ই-বাংলা মেডিক্যালের আইসোলেশনে চলে যাই। ’ 

ডা. শিহাব বলেন, মহান আল্লাহ তায়ালার রহমতে এবং সবার দোয়ায় খুব দ্রুতই আমার ফলোআপ রিপোর্ট নেগেটিভ আসে এবং আমি ২৭ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে আসি। বাসার সবার রিপোর্টও নেগেটিভ আসে। যেহেতু হাসপাতালে অন্য করোনা রোগীদের সঙ্গে থেকে এসেছি তাই বাসায় ফিরে আবারও ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকি।  

পরবর্তীসময়ে সুস্থ হয়ে গত ২০ মে আবারো কর্মস্থলে যোগ দেন জানিয়ে বলেন, সাধারণ মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে থাকি। এরই মধ্যে একজনের মাকে বাঁচাতে প্লাজমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ২৬ মে এজন্য সোজা ঢাকায় চলে যাই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে প্লাজমা দিয়ে ওইদিন রাতেই বরিশালে ফিরে আসি। পাশাপাশি যথানিয়মে কাজ চালিয়ে যেতে যেতে অনুভব করি জ্বর-সর্দি-কাশি অর্থাৎ নিজের শরীরে করোনার উপসর্গ। যদিও প্রথমবার এসবের কোনো লক্ষণই আমার ছিল না। তাই ৩০ মে আবার কোভিড টেস্টের জন্য নমুনা দেই যার রিপোর্ট গতকাল পজিটিভ আসে।

ঢাকা থেকে আসার পর কোনো লক্ষণই ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া এক রোগীকে দেখার পর থেকে কিছুটা সংশয়ে ছিলাম। কারণ উনি ঢাকা থেকে বাবুগঞ্জে এসেছিলেন। যাইহোক সুস্থ হয়ে কাজে ফিরবো এ আশা নিয়েই আগের মতো নিজেকে আলাদা রেখে চিকিৎসা নিচ্ছি। নিয়ম-কানুন মেনে চলার চেষ্টা করছি। আর সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি, করোনা একবার হলে আবার যে হবে না এটা ভাবার কিছু নেই। তাই সচেতনতা আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এটা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। আর উপসর্গ থাকলে কখনো উচিত হবে না, তা গোপন করা, কারণ এ থেকেই সংক্রমিত হবে আশপাশের মানুষ।

ডা. মুহাম্মাদ শিহাব উদ্দিন একজন সুস্থ মন-মানসিকতার মানুষ। তিনি সব সময় সবার সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করেন। সেটা রোগী হোক, বন্ধু হোক আর স্বজন হোক। নিজেকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করতে পেরে সব সময়ই আনন্দিত ছিল বলে জানিয়েছেন সহপাঠী ডা. এস এম মাজেদুল হক।

ডা. মুহাম্মাদ শিহাব উদ্দিন একজন পরিশ্রমী চিকিৎসক ও ভালো মনের মানুষ। নয়তো লকডাউনের মধ্যে একজনের মাকে বাঁচাতে প্লাজমা দিতে ঢাকায় কেন যাবেন। এ কথা জানিয়ে বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন বলেন, প্রথমবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে সাবেক এক এমপির স্ত্রীর জন্য প্লাজমা দিতে ঢাকা যান শিহাব। এরপর আবার তার করোনা ধরা পড়লো, যা খুবই দুঃখজনক বিষয়, তার দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।

বরিশালে দ্বিতীয়বারের মতো করোনায় আক্রান্ত হওয়া প্রথম ব্যক্তি ডা. মুহাম্মাদ শিহাব উদ্দিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০২০
এমএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।